বর্ণবাদের এপিঠ ওপিঠ | হাসিবুর রহমান ভাসানী |

আমি বশির।আমার বয়স ২৬।আজকে কোনো গল্প বলবো না;আমার ২৬ বছরের এ ছোট্ট জীবনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলবো।
জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন পৃথিবীর উষ্ণ অভ্যর্থনা পাইনি বলেই আজ আমার এসব অভিযোগ।

১)আমার উচ্চতা ৫ ফুট ১ ইঞ্চি___আমি লম্বা নই,মাঝারি ও নই;এককথায় খাটো।একটা বয়সে যখন সবাই দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠে,সেই বয়সে আমি ঠিক ততটা বেড়ে উঠতে পারিনি।
তাই খাটো,বেটে,বাঁটুল,ট্যাবলেট এসব শব্দ শুনে শুনেই আমার কৈশোর পার করেছি।
বাবা মায়ের মুখেও ভীষণ আক্ষেপ শুনেছি,কেনো আমি আর একটু লম্বা হলাম না....!!!
আমার ক্লাসমেট বা কাজিনরা সবসময় আমার পাশটায় দাঁড়াতে চাইতো,যাতে করে তাদেরকে বেশি লম্বা দেখায় কিংবা উঁচুতে রাখা কোনো জিনিস সবাই ইচ্ছে করেই আমাকে নামানোর দায়িত্ব দিতো....এভাবে সবাই অনেক মজা লুটেছে।
কলেজ জীবনে একটা মেয়েকে আমার ভীষণ ভালো লাগতো;একদিন অনেক সাহস করে ওকে এ কথাটা বলি....তারপরে পুরো ক্লাসের সবার সামনে এটা নিয়ে ও আমায় ভীষণ অপমান করে।
প্রথম প্রথম এসব ডাকনামগুলো শুনতে আমার বেশ খারাপ লাগতো,আস্তে আস্তে সয়ে গেছি,,এখন আর বেটে,বাঁটুল শব্দগুলো ঠিক আমার কান অব্দি এসে পৌঁছায় না।

২)জন্ম থেকেই আমার গায়ের রঙটা বেশ কালো।
হয়তো জন্মের পরে অন্য সব বাচ্চাদের মতো আমায় অতোটা ফুটফুটেও লাগেনি;সেজন্যই ছোটো থেকেই কালু,কালাই এসব নামেই আমি পরিচিত হয়ে আসছি।
আমারও যে একটা ভালো নাম আছে,সেটা বোধহয়  সবাই ভুলেই গিয়েছে;তাই সময়ের সাথে সাথে আমার কাছে পিতৃপ্রদত্ত নামটাও তার গুরুত্ব হারায়।
প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক সব জায়গাতেই আমার শিক্ষকেরা আমায় খুব ভালোভাবে চিনতেন;('ওই কালো ছেলেটা না..? / তোমাদের ক্লাসের ওই কালো ছেলেটাকে ডাকো তো')
আমার কাছের আত্মীয় স্বজনেরাও আমাকে কালু ছাড়া অন্য কোনো নামে  মানে আমার নিজের নামটা ধরে কোনোদিন ডেকেছেন কিনা সেটা আমার ঠিক জানা নেই।
বর্ণবাদ বা রেসিজম নাকি শুধু ইউরোপ আমেরিকাতেই বিদ্যমান;কিন্তু কার্যত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশটাতেও যে বর্ণবাদের ভীষণ চর্চা হয় তার বড় সাক্ষী আমি নিজেই।
একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো,লোকে সেটা জানার পরে আমি তো একদম উদাহরণ হয়ে গেলাম..সবাই আমাকে দেখিয়ে বলতো যে,দেখ এমন কালো ছেলেটারও গার্লফ্রেন্ড আছে,ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।
এ সমাজের মানুষগুলো ভালোবাসাটাও গায়ের রঙে  মাপে।
ছোটোবেলায় পড়া সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'মানুষ জাতি ' কবিতার
"কালো আর ধলো বাহিরে কেবল,ভেতরে সবারই সমান রাঙা" এই লাইনগুলোকে বড় হওয়ার সাথে সাথে ভীষণ অর্থহীন মনে হলো,শুধু শুধু কাগজ নষ্ট না করলেই পারতেন।

৩)আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান।যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি;তখন আমার বড় ভাই শহর থেকে আমার জন্য একটা বেশ উজ্জ্বল রঙের জামা কিনে আনেন।সবার মতো আমিও নতুন সেই জামাটা পড়েই ঈদের পর স্কুলে যাই।
ম্যাম বলেছিলেন,এই ফুটপাতের জামাটা কই পেলি.......আমার কিচ্ছু বলার ছিলো না সেদিন।
বিশ্বাস করুন ম্যামের সেদিনের এই কথাটা আমার আজ অব্দি স্পষ্ট মনে আছে,মনে হয়না যে,ইহজীবনে কোনোদিন এই বিদ্রুপাত্মক কথাটা আমার মাথা থেকে যাবে।

৪)ছোটবেলা থেকে একদমই মেধাবী ছিলাম না;একটা পড়া মুখস্থ করতে আমার বেশ কয়েক ঘন্টা লেগে যেতো।
এটা নিয়ে মাথায় গোবর,গরু,হাঁদারাম আরো কতো কথা শুনেছি সেগুলো না হয় বাদ ই দিলাম।
আমি একজন ম্যামের বাসায় পড়তে যেতাম;আমার পড়ানোর সময় ম্যাম তার ছয় বছরের বাচ্চাটাকেও নিয়ে বসতেন।
তো একবার একটা পড়া আমি তিনবার পড়েও মুখস্থ করতে পারিনি;ম্যাম তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন,আল্লাহ না করুন .. আমার ছেলেটা যেনো বশিরের মতো না হয়...!!
একদিন স্কুল থেকে বাড়িতে এসে শুনি,গ্রামের একজন শিক্ষিত মুরুব্বি বাবাকে পরামর্শ দিচ্ছেন যে,......ওর তো মাথা নেই,শুধু শুধু পয়সা নষ্ট না করে ওরে একটা গার্মেন্টসে ঢুকিয়ে দে।

৫)আমার বাবা পেশায় নাপিত ছিলেন।
ক্লাস এইটে থাকতে একবার একটা ফ্রেন্ড এর বাসায় যাই।ওর মা আমাকে মুড়ি আর বিস্কুট খেতে দেয়;আমি খাবার খাচ্ছিলাম আর তার সাথে কথা বলেছিলাম।কথা প্রসঙ্গে যখন জানলো আমি নাপিতের ছেলে...উনি বেশ চমকে উঠলেন;আমার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন তুই সেটা আমাকে আগে বলিসনি কেনো..? বাড়িটাসুদ্ধ অশুচি হয়ে গেলো।
খাবারটা তখনও আমার মুখে......................
আসার পথে শুনলাম ওর মা ওকে বকছে এই বলে যে,যার তার সাথে কেনো বন্ধুত্ব করতে গেলো...!!

৬)যখন প্রাথমিকে পড়তাম তখন আমি স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশিই চিকন ছিলাম,চোখে পড়ার মতো।
আমার সহপাঠীরা আমায় নাম দিয়েছিলেন বেঞ্জু,পাটকাঠি,কঞ্চি;
রোজ সবাই আমায় দেখলেই এগুলো বলে ডাকতো।
আমি বাড়িতে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম।
মা আমাকে অনেক ডাক্তার কবিরাজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু কাজ হয়নি।
প্রাথমিক থেকে একটু বড় হয়ে যখন মাধ্যমিকে যাই তখন আমার এই শারীরিক গঠনের জন্য নতুন নাম যুক্ত হয়;কেউ ডাকতো পলিও রোগী,কেউবা আবার  যক্ষা রোগী অথবা এইডসের রোগী কিংবা প্রতিবন্ধী বলেই সম্মোধন করতো।
আমার এই শারীরিক গঠনের দূর্বলতা নিয়ে অনেক মানুষ আমায় অনেকভাবেই অপমান করেছে কিন্তু কেউ একটাবারের জন্যও ভালোবাসেনি,কাছে টানেনি;সবসময় সবার থেকে আলাদা করেই রেখেছে।

আসলে আমার মতো এতখানি সৌভাগ্য নিয়ে তো খুব কম মানুষ জন্মায়;তাই পৃথিবীর চোখে আমাদের কষ্টগুলো ধরা পড়ে না।
চারদিকে ভীষণ মানবতার মিছিলে ঢাকা পড়ে যায় এখানকার নিত্যদিনের বর্ণবাদগুলো...!!!

স্রষ্টার কাছে আমার একটাই চাওয়া,তিনি যেন পৃথিবীতে আমার মতো আর একজনকেও না পাঠান,যাদের পিতৃপ্রদত্ত নামগুলো হারিয়ে যায় বিদঘুটে সব ডাকনামের ভীড়ে।

--বর্ণবাদের এপিঠ ওপিঠ 
--হাসিবুর রহমান ভাসানী
   

Post a Comment

0 Comments