অতীতের কিছু আক্ষেপ | হাসিবুর রহমান ভাসানী |

Hasibur Rahman Bhashani  

ন'বছর হলো নিলুয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।কিন্তু আজো আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছিনা।পরিবার থেকে চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য।
বয়সটা ৩১ পেরিয়ে এখন ৩২এর কোঠায়।
বার বার সময় নিচ্ছি এই বলে যে,আমার আরো কিছুটা সময় লাগবে নিজের জন্য।
বাবা মা আজকাল ঠিকমতো আমার সাথে কথাও বলেনা মুখগোমরা করে থাকে।
মা বললেন,দেখ বাবু তুই এবার অন্তত একটু সংসারী হ,আমরা তো কদিন বাদেই মরে যাবো,নাতি নাতনীদের মুখটাও কি দেখে যেতে পারবো না..?
-মা তুমি তো জানো আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে ভীষণ বিরক্ত লাগে;
 সবকিছু তো ঠিকঠাকই চলছে।থাকিনা এভাবেই আরো কয়েকটা বছর।
আমার মা আগের দিনকার হলেও বেশ শিক্ষিত এবং সচেতন।মা আমার সবথেকে কাছের বন্ধু,মায়ের কাছে আমি আজ অব্ধি কিছু লুকাইনি।
মা নিজেও জানে আমি কেনো এমনটা করছি।
মা এবার বললেন,
-দেখ বাবু ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে,কেমন দিব্যি ঘর সংসার করছে,শুনলাম একটা বাচ্চাও আছে।
আচ্ছা ও পারলে তুই কেনো পারছিস না..?
-মা এসব ফালতু কথা বাদ দাও তো,সবাই সবকিছু পারে না।
আচ্ছা আমি চাকরি করছিতো,রোজ সকাল সন্ধ্যা অফিস যাচ্ছি তারপরও কেনো এমন করছো;
এমন না যে তোমার ছেলে,কোনো মহাপাপ করছে তরিঘরি করে তাকে এখনই বিয়ে দিতে হবে।

আসলে,এতগুলো বছর পরেও আমি ঠিক হতে পারছিলাম না,বিষন্নতা আমায় শেষ করে দিচ্ছিলো।
এবার একটু নিলুয়ার পরিচয় দেই।
না আমার প্রথম প্রেম একদমই নয়,সর্বশেষ প্রেম বা ভালোবাসা যাই বলিনা কেনো সেটাই;
ওর সাথে পরিচয়টা হয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পরপরই।একই ডিপার্টমেন্ট। দুজনেই অ্যাস্ট্রোনমির স্টুডেন্ট।
সম্পর্কের গোড়াপত্তন ও ওই প্রথম বর্ষেই।
দুজনেই ইউনিভার্সিটির হলে থাকতাম,তাই সকাল সন্ধ্যা আমাদের একসাথেই কাটতো।
নিলুয়া জহিরের প্রেম এটা গোটা ভার্সিটির সবাই জানতো,এমনকি শিক্ষকরাও।
রোজ পাশাপাশি থাকতে থাকতে একটা সময় সেটা অভ্যাসে রূপ নেয় আর অভ্যাস থেকে সময়ের সাথে সাথে একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং দায়িত্ববোধ দুটোই বাড়ে।

এমনি করে প্রায় চারটা বছর পার করলাম;ততদিনে আমাদের আমাদের সম্পর্কের কানাঘুঁষা ওদের বাড়িতে ও পৌঁছে যায়।
আর এই ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর থেকেই ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসতে থাকে।
ও বারাবরই সেগুলো রিজেক্ট করে দিচ্ছিলো;আমাকেও কোনোদিন এসবে ও নাক গলাতে দেয় নি।সবসময় বলতো,আমি নিজেই এগুলো হ্যান্ডেল করতে পারবো।

তখন পৌষ মাস,নিলুয়ার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে; ও বাড়ি চলে যায় কিছুদিনের জন্য।
সেই সময়ে নিলুয়াদের বাসায় একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে,ছেলে ভালো একটা সরকারি চাকরী করে।
ওর বাবা,মা বড় ভাই সবাই সিদ্ধান্ত নেয় নিলুয়াকে ওখানেই বিয়ে দেবে।
নিলুয়া বার বার ওর পরিবারকে না করে দিচ্ছিলো;
আমাকেও জানায়নি,আমি আবার ঝামেলা বাঁধাতে পারি তাই।
একটা ব্যাপার কি জানেন,ছেলে আর মেয়েদের মাঝে শারীরিক ছাড়াও আরো একটা বেসিক ডিফারেন্স আছে;
ছেলেরা বা পুরুষেরা খুব সহজে ইমোশনাল ব্লাকমেইল এর ফাঁদে পা দেয় না কিন্তু মেয়েরা খুব সহজেই এখানে আটকে যায়;
যেমনটা গিয়েছিল আমার নিলুয়া,ওর অসুস্থ মায়ের অশ্রুসিক্ত আবদারের অদৃশ্য জালে ও সেদিন জড়িয়ে পড়েছিল।
নিলুয়া ভীষণ দ্বিধায় ভুগছিল।
একদিকে আমি আর অন্যদিকে ওর অসুস্থ মা।পনেরো দিন পরে নিলুয়া
আমাকে কিছু না জানিয়েই হল থেকে ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি চলে যায়।
এরপরে একদিন দুটো বন্ধুকে নিয়ে নিলুয়াদের বাড়িতে গেলাম দেখলাম ওর মা অসুস্থ,সারাক্ষণ ওকে পাশে থাকতে হয়;
নিলুয়ার চোখে কালি পড়ে গেছে,ওর দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না;একটা অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন লক্ষ করলাম ওর মাঝে।
চলে এলাম ওদের বাড়ি থেকে;
আজকাল নিলুয়া আমার সাথে একদমই যোগাযোগ করছে না;নাম্বারটাও বন্ধ। পরদিন আমি একটা চিঠি পাই নিলুয়ার লেখা,
'জহির,
আমার কিছু করার ছিলোনা,মায়ের শরীরটা ভালো না খুব করে চাইছিলো যেন আমি তার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করি;আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারলাম না,আমাকে মাফ করে দিও'
ইতি নিলু
এরপরে আমি অনেকবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম নিলুয়া আর আমার সাথে কোনোদিনও দেখা করেনি;
নিলুয়ার বিয়ে হয়ে যায়,আর তার কিছুদিনের মাথায় ওর মা ও মারা যায়;
ওই দিনগুলো আমার আজীবন মনে থাকবে;
আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম,মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ক্ষণ কাঁদলাম।
একমাসধরে ভার্সিটিতে যাচ্ছিনা,ইউনিভার্সিটির করিডোর আমায় আর টানে না;সেমিস্টার ড্রপ খাই।
আর এমনি করেই শেষ হয় নিলুয়া জহিরের উপাখ্যান।

যাই হোক,মা আমাকে না জানিয়েই পাত্রী দেখে ফেললেন,শুনলাম বিয়ের দিন তারিখ ও নাকি ঠিক করে ফেলেছেন। আমার অবশ্য এখন এসবে কোনো আগ্রহ নেই।
বিয়ের দিন আমার কেমন যেন নিজেকে সার্কাসের জড়বস্তুর মতো মনে হলো।
নিজের অনিচ্ছায় ই বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম।
শুরু হয় আমার বিবাহিত জীবনের নতুন অধ্যায়।
নিলুয়াকে তখনো আমি ভুলতে পারিনি।
আমি জানতাম আমার স্ত্রীর প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব কর্তব্যবোধ আছে,হ্যাঁ নামমাত্র হলেও আমি সেগুলো ঠিকই পালন করতাম।
কিন্তু তারপরও কেন যেন আমি ওর মাঝে আমার নিলুয়াকেই খুঁজতাম।
আমাদের মাঝে গড়ে উঠলো একটা ভালোবাসাহীন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক।
আসলে আমি অনেক চেষ্টা করেও আমার স্ত্রী মহিমাকে নিলুয়ার জায়গায় বসাতে পারি নি।
তাই তাকে আর আমার ভালোবাসাটা ঠিক হয়ে ওঠেনি।
দূরত্ব বাড়তে থাকে আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে।
ও হয়তো ভাবছিলো আমাদের একটা সন্তান হলে হয়তো আমি সংসারে মনোযোগী হবো,সন্তানের সুবাদে হলেও ওকে ভালোবাসবো।
কিন্তু তা আর হলো কই,সন্তান হলো ঠিকই কিন্তু তার মায়ের জন্য আমি চেষ্টা করেও মন থেকে সামান্য ভালোবাসাটুকুও আনতে পারি নি।

বাচ্চার বয়স যখন এক বছর তখন আমার স্ত্রী বাচ্চাকে সাথে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে চলে যায়।
হ্যাঁ,মায়ের অনুরোধে বেশ কয়েকবার আমি ওকে আনতে গিয়েছিলাম কিন্তু ও আসেনি।
ছেলের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন ওকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসি।
এই আগষ্টের সাত তারিখে ওর জন্মদিন ছিলো,
ছেলে আমায় বললো "বাবা,চলো মাকে নিয়ে আসি"
এক মিনিট ধরে কথাটা আমার কানে অনেকবার বাজলো....বাবা চলো মাকে নিয়ে আসি.....
তার পরদিন বাবা ছেলে মিলে গেলাম,আমার স্ত্রীকে ফেরাতে।
আমার ছেলে তার মাকে ধরে টানছে,মা বাড়ি চলো;
আমি মহিমার দিকে তাকিয়ে বললাম;
আমার জন্য না হয় নাই গেলে,ছেলের জন্য হলেও এবার অন্তত বাড়ি চলো।
মহিমাকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম।
এখন ওকে বেশ ভালোবাসি,আদর ও করি...
না ভালোবাসি বলাটা বেধহয় ঠিক হবে না,ওর প্রতি আমার যেটা তৈরি হয়েছে সেটা একটা মায়া,
একরকম অভ্যস্ততা।ভালোবাসা তো ওটা ছিলো যেটা আমি নিলুয়াকে দিয়েছিলাম।

জগতের কিছু মানুষ এমন অভ্যস্ততাকেই ভালোবাসা হিসেবে মেনে নিয়ে কাটিয়ে দেয় গোটা এক জীবন;
কোনোদিন হয়তো মহিমা বুঝতেও পারবেনা এটা কি আদৌ ভালোবাসা নাকি ভালোবাসায় মোড়ানো একটা অভ্যস্ততা।
যাই হোক,এরপরের বছর আমি কন্যাসন্তানের বাবা হই,মেয়ের নাম রেখেছি নিলুয়া;

এই নিলুয়ার মাধ্যমে যদি আগের নিলুয়াটাকে মোছা যায় সেই চেষ্টাটাই করবো আমার বাকি জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে..........!!!!

---অতীতের কিছু আক্ষেপ
---হাসিবুর রহমান ভাসানী

Post a Comment

0 Comments