আমি নিলুফা রহমান।
তিন বছর আগে যখন আমি রিপনের হাত ধরে ঘর ছাড়ি তখন আমার বয়স ছিলো ২১বছর।
রাজনগর কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি।
বাবার রিপনকে একদমই পছন্দ ছিলোনা;এমনটা না যে ও বেকার;
একটা ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি করে।
বাবা আমার অমতেই তার দেখা ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলেন।বাধ্য হয়ে বিয়ের চারদিন আগে আমি রিপনের সাথে পালিয়ে যাই।
বাবা ব্যাপারটাকে একদমই মানতে পারেন নি।ফোন করে স্রেফ জানিয়েই দিলেন যে, তোর জন্য আজ থেকে এই ঘরে ওঠা নিষেধ।তুই এই বাড়িতে এলে আমার মরা মুখ দেখবি।
দূরত্ব বাড়লো আমার পরিবারের সাথে;
আস্তে আস্তে যোগাযোগ বন্ধ হলো আমার মা,বড় ভাই এমনকি আমার একমাত্র আপার সাথেও।
রিপনের সাথে পালিয়ে গিয়ে যখন ওদের বাড়িতে উঠি,তখন ওর বাড়ির সবাই আমাকে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়।আর আমিও পাই নতুন একটা পরিবার।
চেষ্টা করি ওদের সাথে সবসময় হাসিখুশি থাকার যাতে করে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাড়ির কথা ভুলে থাকি।
আমি রান্না জানতাম না,বাড়িতে সবসময় মা ই রান্না করতেন;এ বাড়িতে আসার পর আমার শ্বাশুড়িই আমাকে একদম হাতে ধরে রান্নাটা শেখালেন।
বাড়ির জন্য হাজার মন খারাপ থাকলেও সবসময় এটা ভেবে তৃপ্তি পেতাম যে,আমাদের সাড়ে তিন বছরের সম্পর্কটা অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি।
হঠাৎ একদিন সকালে মায়ের ফোন এলো।মা বললেন...
তুই এমনটা কেনো করলি..?
তোর বাবা এখন তোর নামও শুনতে পারে না।
যাইহোক নিজেই যখন নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিস তখন আমার আর কি বলার। ভালো থাকিস..!!
মায়ের সাথে কথা বলার পর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো; আপাকে কল দিলাম..রিসিভ করলোনা।
এমনি করে এ বাড়িতে চার মাস পেরিয়ে গেলো।
এখন বর্ষাকাল।প্রায় প্রতিদিন ই মুশলধারে বৃষ্টি হয়।
বৃষ্টিতে ভেজার শখ আমার ছোটোবেলা থেকেই।
আজ রিপনের অফিস নেই তাই বেলা এগারোটা বাজে এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে,আমি ওকে ঘুম থেকে টেনে তুলে ছাদে নিয়ে আসলাম,একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো তাই।
ছাদে পা দিতেই পিছলে পড়ে গেলাম;আসলে খেয়াল করিনি টানা এক সপ্তাহ বৃষ্টি হওয়ায় ছাদে শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে ছিলো আগে থেকেই।
এবারের মতো আমাদের আর ভেজা হলোনা।
পায়ের গোড়ালি ফুলে উঠছে,প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
সন্ধ্যাবেলা রিপন আর আমার শ্বাশুড়ি আমাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছায়।
তার একদিন বাদে জ্বর ও আসে।ও অফিস থেকে দু দিনের জন্য ছুটি নিয়ে নিয়েছে।হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি অবস্থায় বার বার বাড়ির কথা মনে পড়ছিলো;
রিপনকে বললাম বাড়িতে একটা কল দিতে।
ওপাশ থেকে ফোনটা বাবা রিসিভ করলো;রিপনের গলা শুনতেই বাবা চেচিয়ে উঠলো.....হারামজাদা তুই কল দিয়েছিস কোন সাহসে..?
--আসলে নিলু বেশ অসুস্থ
-- মরুকগে...!!
রিপন ফোনটা কেটে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
বাবা হয়তো ভাবছিলেন এটা আমাদের একটা বাহানা।
জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়ছে।রিপন আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে।
ছয় দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই।
এর মাসখানেক পরে একদিন রিপন অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাসায় আসলো মিষ্টি নিয়ে।
ওর চোখেমুখে আনন্দ।
ওর প্রমোশন হয়েছে সেকেন্ড ম্যানেজার পদে।
সেই সাথে আরো একটা সংবাদ ছিলো যেটা আমার কাছে দুঃসংবাদের মতোই।
ওর রাজশাহীতে পোস্টিং হয়েছে।এক সপ্তাহের মাঝে ওখানে শিফট করতে হবে।
এদিকে সংসার সামলানোর চাপে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষেই আমার পড়াশোনার ইতি টানতে হয়।
নওগাঁ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দুজন রাজশাহীতে পা বাড়ালাম।
এখানে ওর ডিউটি সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা অব্ধি।
সারাদিন আমি বাসায় একা পড়ে থাকি।
এই সময়টায় রান্না করা,সিরিয়াল দেখা,বই পড়া,ঘন্টায় ঘন্টায় ওকে কল দেয়া
আর বিকেল ৪ টার জন্য অপেক্ষা করা এমনি করেই সময় পার হয়ে যায়।
আর সন্ধ্যার পরে প্রায়ই আমরা বের হই কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাই,কেনাকাটা করি এগুলো।
হঠাৎ ওর একটা অফিসের ট্রেনিং পড়লো ১৩ দিনের জন্য চিটাগং এ।
আমাকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে ও চলে গেলো।
এতদিন পর এ বাড়িতে এসেছি তাই সারাদিন তাদেরকে সময় দেয়ায় ওর সাথে যোগাযোগটা একটু কমে যায়।মানে আগের ঘন্টায় ঘন্টায় কলটা এখন সকাল সন্ধ্যায় কনভার্ট হয়েছে।
১৫দিন পর আমরা আবার রাজশাহীতে চলে যাই।
চট্টগ্রাম থেকে আসার পর থেকেই দেখলাম ও বেশ মোবাইল আর ল্যাপটপেই ব্যস্ত থাকে।
আমার কাছে অবশ্য এটায় দোষের কিছু মনে হয়নি।
পরদিন ওর সাথে দুপুর ১টায় কথা হলো আবার ২.২০ এ কল দিলাম..
-একটু আগেই না কথা হলো,আবার কি..?
আমি বিজি আছি...রাখছি..বাই।
পরে চারটায় ও আমাকে কল দিয়ে বললো আজকে ফিরতে একটু দেরি হবে একটা জরুরি মিটিং আছে।
রাত নয় টায় বাসায় আসলো; এর মধ্যে আমার মিনিমাম ২০টা কল দেয়া হয়ে গেছে।
একবার ও রিসিভ করেনি।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম..
-কল রিসিভ করোনি কেনো..?
-বললাম না যে মিটিং এ ছিলাম।আর দেখতেই তো পাচ্ছো দিন দিন কেমন কাজের চাপ বাড়ছে।
-তাই বলে একবারও রিসিভ করার সময় হয়নি..?
-বাচ্চাদের মতো কথা বলোনাতো..!!
গত কয়েকমাস থেকেই একটা ব্যাপার খেয়াল করছি যে,আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে ও আবার ল্যাপটপ নিয়ে বেসে রাত ৩-৪টা পর্যন্ত জেগে থাকে।
একদিন জিজ্ঞেস করছিলাম বললো অফিসের কিছু কাজ বাকি থাকে সেগুলো করি।
আমারা একসাথে থাকি ঠিকই কিন্তু দিন দিন কেনো যেন মনে হচ্ছে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি।
ও আর আজকাল আমার কোনো কথাই শুনেনা,শেষ পাঁচ মাস ধরে কোনোদিন সন্ধ্যা সাতটা কোনোদিন আবার রাত দশটায় বাড়ি ফেরে;
আর এই পুরো ১০-১২ ঘন্টা সময়ের মধ্যে ও শুধু একটাবারই কল দেয় চারটার দিকে শুধু এটা বলার জন্য যে,আজ ফিরতে দেরি হবে।
এমন করে আমাদের টানাপোড়েনের পাঁচ মাস কেটে গেলো।
ওর অবহেলাগুলো আমি আর নিতে পারছি না।
ভাবলাম ওকে একটু বুঝিয়ে বলে দেখি কোনো কাজ হয় কিনা;
রাত্রিবেলা ওকে বললাম...
-দেখো আমি সারাদিন বাসায় একা পড়ে থাকি,
তুমি না একটা কল দাও না রিসিভ করো; এমনটা কেনো করছো..?
-তো তুমি কি চাও তোমার সাথে আমি সেকেন্ডে সেকেন্ডে কথা বলি।
ওকে,একটা ওয়াকিটকি দিয়ে দিও ২৪ ঘন্টাই কথা হবে..যত্তসব..!!
-কেমন অফিস তোমার যে একদিন সাতটা,একদিন নয়টা একদিন দশটা বাজে আসতে..?
-যেটা বুঝোনা সেটা নিয়ে কথা বলবেনা;তোমার জ্ঞান তো ওই অনার্স অব্ধি....
আমি চুপ হয়ে গেলাম।আর কিছু বলার ইচ্ছেই রইলো না।
রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে আমি বললাম..
-তুই আর আমায় ছুঁবি না..
-হ্যাঁ,আমি তো তোকে ছোঁয়ার জন্য বসে আছি।
ওর কথাগুলো ভীষণ অচেনা লাগছিলো আমার।
এই রিপনকে তে এতকাল আমি দেখিনি।
এদিকে আমার বেশ ভয়ও বাড়ছিলো, ও আবার অন্য কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েনি তো..?
আমি ওর ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড চাইলাম..দিলো না
ফোনের প্যাটার্ন টাও বদলে ফেলেছে।
আমার চিন্তার রেখা আরো গাঢ় হতে লাগলো।
পরদিন আবারও ওকে খুব ভালোভাবে বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হই।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ও আমাকে আর চায় না বা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে।
রাজশাহী শহরের সবটা আমি ঠিকঠাক চিনি না,কেবল কয়েকটা রেস্টুরেন্টে,দুটো মার্কেট আর ওর অফিস তাও একদিন রিকশা থেকে দেখিয়েছিলো।
কোনোকিছুতেই যখন কাজে দিচ্ছিলো না তখন ভাবলাম একদিন একটু ওর অফিসে গিয়ে দেখে আসি।
চারটা বাজার পাঁচমিনিট আগে ওর অফিসের অপজিটে টেইলর্সের দোকানে গিয়ে বসলাম ওর অফিস থেকে কেউ বেরুলে এখান বসে স্পষ্ট দেখা যায়।
৪:০৫ এ ও বের হলো,সাথে একজন মহিলা,আমার থেকে বয়স অনেকটা বেশি।
একটা সিল্কের শাড়ি পড়া।
অফিসের বাদ বাকি সবাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে।
কেবল দেখলাম ওরা দুজন একটা লাল গাড়িতে করে কোথায় যেন যাচ্ছে।
ওকে একটা কল দিলাম রিসিভ করলো না।
আজ ফিরলো রাত দশটায়।
আমি কিচ্ছু বলিনি,এমন একটা ভাব ধরে ছিলাম যেন কোনোভাবে টের না পায় যে আমি আজ নজরদারি করেছি।
পরদিন আবার একই টাইমে একই অবস্থায় দেখলাম দুজনকে।
ওরা যাওয়ার পরে,
দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম এই মহিলাকে চেনো..?
হ্যাঁ ইনি তো এখানকার ম্যানেজার।
দারোয়ানের হাতে একশো টাকা গুঁজে দিয়ে একে একে শুনতে শুরু করলাম আদ্যোপান্ত।
-ওনারা তো স্বামী স্ত্রী।
-কি বলো এসব উল্টা পাল্টা..?
-আমি রিপনের স্ত্রী।
দারোয়ান কিছুটা চমকে গেলো।
ওই মহিলার নাম রুমি।
একবছর হয় এ অফিসে জয়েন করেছেন।
উনি বিধবা ছিলেন।
বিয়ের তিন মাসের মাথায় ওনার স্বামী মারা যায়।
.............................................
এতক্ষণে রিপনের চট্টগ্রামের অফিস ট্যুরের ধারণাটাও ক্লিয়ার হলো।
পরে জানতে পারলাম মাস দেড়েকে আগে ওরা বিয়ে করেছে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আমি কি করবো বা আমার কি করা উচিত...!!!
আমার তো পায়ের নিচের মাটি আর মাথার ছাদ দুটোই ছিলো রিপন।
এখন না আছে ও না আছে আমার পরিবার।
আমার সমস্ত ভালোবাসা পিছুটান নিমিষেই প্রচন্ড ঘৃনায় রূপান্তরিত হলো।
রাত এগারোটা নাগাদ রিপন বাসায় ফিরলে ওকে জিজ্ঞেস করি...
-তোমার সাথের ওই মহিলাটা কে ছিলো...?
-কোন মহিলা...?
-কে ছিলো..?
-তুমি জানলে কার কাছে..?
-কে ছিলো..?
-আমার অফিসের ম্যানেজার।কাজ ছিলো একটু তাই।
-ম্যানেজার বুঝি তোমাকে আজকাল কাজের জন্য বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যায়।
রিপন চিৎকার দিয়ে উঠলো..কি সব জঘন্য কথা বলছো তুমি নিলু..?
-ওকে বিয়ে করলে কবে..?
-রিপন হকচকিয়ে গেল..মানে..?
-শুনতে পাচ্ছো না কি জিজ্ঞেস করছি...কবে বিয়ে করেছো..?
রিপন এবার একদম কান্নাকাটি শুরু করে দিলো..
"মাফ করে দাও প্লিজ...ভুলের মাথায়...আচ্ছা কাল ই ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব...আমি আর অফিসেই যাবো না..
নিলুফার মাথায় রক্ত চেপে গেলো।
ছোটোবেলা থেকেই ও ভীষণ জেদী।
এই জেদের বসেই একদিন ও রিপনের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিলো আর............................এই জেদের বসেই ওইদিন রাত তিনটায় নিলুফা রান্নাঘর থেকে ধারালো ছুড়িটা এনে রিপনের গলায় বসিয়ে দেয়।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছে....বিছানার চাদর থেকে তোষক ভেদ করে চুইয়ে চুইয়ে ফ্লোরে পড়ছে.... ভালোবাসার রক্ত....!!
আর সকালের আলো ফোটার আগে নিলুফা নিজেও ঝুলে পড়ে সিলিং ফ্যানের সাথে।
একটা কাগজে শুধু এটুকু লিখে যায়-
বাবা,তোমার কথাই রাখলাম; (মরুকগে..)
পারলে মাফ করে দিও।
--ভালোবাসার রক্ত
--হাসিবুর রহমান ভাসানী
[ভীষণ নরম কাদামাটি পুড়েই কিন্তু ইট হয়....]
0 Comments