সময়টা তখন ২০০৯ সাল।ডিসেম্বরের তীব্র শীত উপেক্ষা করেও নতুন একটা টিউশন নিলাম উচ্চতর গনিতের;সকাল ৭টার ব্যাচ।
সকালের ঘুম কাটিয়ে উঠতে পারতাম না বলে প্রায়দিনই আমার টিউশনে যেতে দেরি হতো আর সেই সাথে স্যারের বকুনি তো আছেই।
একবার টিউশনে গিয়ে দেখি স্যার শনিবারের টেস্ট এক্সাম নিচ্ছেন;পিছনের বেঞ্চিতে এক কোনায় গিয়ে বসলাম।আগের রাতে কিছুই পড়াশোনা করিনি বলে আমার কলম চলছিলো না।
এই বেঞ্চেরই অন্য প্রান্তে বসছিলো সঙ্গীতা;
উইমেনস কলেজের ছাত্রী;কোঁকড়ানো চুল,চোখে চশমা দেখতে অনেকটা দিল চাহতাহে সিনেমার প্রীতি জিনতার মতো লাগছিলো।
সবার আগেই ওর লেখা শেষ হলো,নিজের থেকেই আমার দিকে ওর খাতাটা বাড়িয়ে দিলো।আর আমি সেটা দেখেই পুরো কপি পেস্ট করে সে যাত্রায় বেঁচে যাই।
আর সেইদিন থেকেই ওর প্রতি আমার সামান্য দূর্বলতা কাজ শুরু করে।
এরপরে আর কোনোদিন আমার টিউশনে লেট হয়নি বরং সবার আগে উপস্থিত হতাম যাতে ওর সাথে বসা যায়।
তাই আমাদের শুরুটা খুব ভালো বন্ধুত্ব থেকেই।
টিউশন শেষে ওর সাথে বেশ খানিকটা পথ একসাথে হাঁটা যাবে ভেবে পরদিন থেকে আমি সাইকেলটাও নেয়া বন্ধ করে দিলাম।তাই এই দেড় মাইলের পথ আমার রোজ হেঁটেই যেতে হয়।
আমার বয়সটা তখন অব্ধি আঠেরো ছোঁয় নি।
এরপরে যা যা হয় আর কি....
ফোন নম্বর নেয়া....রোজ সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কল দেয়া কিংবা মাঝ রাতে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া না বুঝতে পারার বাহানায় কল দিয়ে ওর সাথে আরো একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা।
কৈশোরের সম্পর্কগুলো বোধহয় এমনই হয়;
আমাদের সম্পর্কটা প্রেমে গড়াতে সময় নেয় দু মাসের ও বেশি।
একবার আমার বেশ নিউমোনিয়া হয়েছিল,পড়তে যেতে পারছিনা গত এক সপ্তাহ।
সঙ্গীতা হুট করে একদিন আমার বাসায় চলে আসে।
আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছিল মা আর ছোটোবোনের সাথে ওকে দেখে।
ও আমার পাশে পাঁচ মিনিটের মতো বসে ছিলো।
আমি এই সময়টুকুতে ওর চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম।
হয়তো আমি ওর মাঝেই সেদিন আমার জীবনসঙ্গিনীকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
মা আর ছোটোবোনটা এটা নিয়ে আমার সাথে পরবর্তী সময়ে অনেক হাসি ঠাট্টা করেছে।
মার্চের ১৯ তারিখ রাতে অনেক ভেবে ওকে একটা কল দিয়ে বলি....
-সঙ্গীতা আমার কিছু কথা ছিলো....
ও বললো
-আমি জানি...
-জানিস ই যখন তখন তুমিই ই বলো
-না তুৃমি
-না তুমি
-আরে বুদ্ধু এগুলো ছেলেদেরই আগে বলতে হয়।
-আমি কেবল I Love You বলেই ফোনটা কেটে দেই।
মাঝে মাঝে এখনও ভাবিন সেই দিনগুলোতে কতইনা লাজুক ছিলাম আমি।
এরপর থেকে রুটিন করে সপ্তাহে দুই দিন টিউশন মিস দিয়ে ওর সাথে নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতাম।
বিশেষ দিনগুলোতে ওখানটায় আমরা ঘুড়ি উড়াতাম।এটা ওর বেশ পছন্দের ছিলো।
ফোনে অনেকবার আই লাভ ইউ বললেও ওর সামনে দাঁড়িয়ে এটা বলতে আমার দেড় মাস সময় লেগেছিল।
প্রায় দিনই সাইকেল নিয়ে বিকেলবেলা ওর বাসার সামনে বেল দিতাম;আর বেলকনিতে ওকে একনজর দেখতে পাওয়ার মধ্যে যেই সুখটা পেতাম
সেটা আমি আজও অনুভব করতে পারি।
বিকেলবেলা নানা অযুহাতে ওর ছোটো ভাইকে নিয়ে পার্কের ওই খোলা ময়দানটায় আসতো।
হাজার মানুষের ভীড়েও দূর থেকে আমার চোখদুটো ওর ওপরেই পড়ে থাকতো পুরোটা সময়জুড়ে।
না কাছে যাওয়া বলতে আজকাল যতটা কাছে যাওয়া বুঝায় সেদিনের আমিটার মনে এ ধারণাগুলো কখনোই জন্মেনি।
ওর জন্মদিনে ঠিক রাত ১২টায়,অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আমার সাইকেল ওর বাড়ির সামনে বেল দিয়েছে।
এরপরে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা হলো।
পরীক্ষা শেষে আমার ঢাকায় আসতে হবে ভার্সিটির কোচিং এর জন্যে।
তার আগেরদিন ওর সাথে দেখা করলাম।
একজোড়া নীল রঙের চুড়ি দিয়েছিলাম ওকে।
হ্যাঁ সেইদিনই প্রথম ওর হাত ছোঁয়া।
ওর হাতটা খুব শক্তভাবে ধরে রূপসার তীরে সূর্যাস্তের ঢলে পড়া দেখলাম।
কারো মুখে কোনো কথা নেই।
আসার সময়ে আমার চোখের জলটা সঙ্গীতার কাছ থেকে লুকাতে পারিনি।
ওটাই ছিলো আমাদের শেষ দেখা। পরদিন ঢাকা চলে এলাম।
দূরত্ব বাড়লো শহরের সাথে আমার,আর যোগাযোগ ও কমতে থাকলো সঙ্গীতার সাথে।
তখন আমাদের সম্পর্কের বয়স তিন মাসের একটু বেশি।
এদিকে পড়াশোনার প্রচন্ড চাপে ওর ক্রমাগত দূরে চলে যাওয়াটা আমি ঠিক টের পাইনি।
এরপরে অক্টোবর মাসের এক সকালে,সঙ্গীতা জানালো আমাদের সম্পর্কটা আর রাখা যাবে না।
হাজারটা অসঙ্গতি দেখালো আমাদের এ সম্পর্কের।
আসলে চলে যাওয়ার সময় কেউই চায় না দোষটা তার নিজের ঘাড়ে পড়ুক।
এরপরে হয়তো আমার পাগলামি থামাতেই ও বললো যে,কদিন পরেই ওর বিয়ে।।
আসলে কাউকে দূরে সরানোর জন্যে এই কমন অযুহাতটা খুবই সহজলভ্য।
সত্যি কারণটা জানতে আমার আরো দেড়মাস সময় লাগে।
ততক্ষণে অবশ্য ও নম্বর বদলে নিয়েছে।
দশম শ্রেণি থেকেই পলিটেকনিকের এক ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক।
আর দীর্ঘ সম্পর্কে একটা কমন ব্যাপার থাকে যে,
মাঝখানে এরা ঝগড়া বা অভিমানবশত কারণে সাময়িক বিরতি নেয়।
আমি আর আমার তিন মাসের ভালোবাসাটা সঙ্গীতার কাছে ছিলো এমনই এক সাময়িক বিরতির অধ্যায়।
এটাই ছিলো আমার প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোলাগা এবং ভালোবাসা দুটোই।
সবকিছু জানার পরে কর্পূর হয়ে উড়ে গেলো আমার ভালোবাসার সবটুকু ঘ্রাণ।
মনে মনে এখনো ভাবি ওর সাথে সেদিন না দেখা হলেই বোধহয় ভালো হতো।
এখন আমার বয়স ২৯....সঙ্গীতার অধ্যায় শেষ হয়েছে প্রায় এক যুগ।
একটা অদ্ভুত বিষয় হলো সেদিনের পর থেকে আজ অব্ধি আমি আর ওর কোনো খোঁজ পাইনি।
এটাও জানিনা যে,ও আদৌ বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে।
মাঝে মাঝে দর্পন কবিরের লাইনের সাথে নিজেকে মেলাই...
'বসন্ত নয়,আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিল মিথ্যে ভালোবাসা'
এতগুলো বছর পার হলো,আমার সেদিনের সেই ভালোবাসাটা এখনো আকাশের বুকে লুব্ধক হয়ে ধরা দেয়;
আসলে ভালোবাসারা কখনো মরে না।
স্তিমিত হয় বা কোথাও গিয়ে থেমে যায়...কিন্তু একবারে হারিয়ে যায় না কখনোই...!!!!
-প্রথম প্রেমের গল্প
-হাসিবুর রহমান ভাসানী
0 Comments