সুখ বনাম স্বপ্ন | হাসিবুর রহমান ভাসানী |

Hasibur Rahman Bhashani   

যখন কেউ কোনো পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে কিংবা খুব বড় কোনো সফলতা অর্জন করে তখন অন্যরা তাকে পুরষ্কৃত করে অভিবাদন জানায়;
আচ্ছা,আপনি কি কখনো নিজেকে নিজে পুরষ্কৃত করেছেন..?
আমি কিন্তু করেছি;একটা গ্রান্ড ট্রিট দিয়েছি,নিজের সফলতায় একান্তই নিজেকে।
আজ আমি ভীষণ খুশি আর সে জন্যই নিজের সবথেকে ভালো লাগার জায়গা দার্জিলিং এ চলে এসেছি গত রাতে।নিজকে কিছুটা শান্তি দেয়ার জন্যে।
বিকেলে বেরিয়েছি টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে,শহর থেকে ১১ কি.মি. দূরে,প্রচন্ড ঠান্ডায়ও গায়ে জড়ানো সামান্য একটা শার্ট ই এখন আমাকে ভীষণ উত্তাপ দিচ্ছে।
হাতে একটা বিয়ার নিয়ে টাইগার হিলের একদম চূড়ায় বসে লিখছি আমার অভ্যুত্থানের এই গল্পটা।

আমি তুষার; আর আমার বর্তমান পরিচয় হলো ব্যান্ড দল 'ভূমিহীন' এর প্রধান গায়ক।

আমার সঙ্গীত জীবনের সূচনাটাই হয় মাধ্যমিকে,তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। বাবা কলেজ শিক্ষক।দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে আমি সবার বড়।ফাইনাল এক্সাম শেষে বাবার কাছে আবদার করে বসলাম একটা গিটার কিনে দেয়ার জন্য।বাবা কিনে তো দিলেনই না উপরন্তু আমার টিউশন আরো দুটো বাড়িয়ে দিলেন।বাবার উপর প্রচন্ড রাগ জমেছিল সেদিন।ওই সময়টাতে আমার কাছের তিন বন্ধু রবি,কিশোর আর জাহিদ ওদেরও গানের নেশাটা ঝাপটে ধরেছিল।অবশেষে চারবন্ধু মিলে ভাগাভাগি করে একটা গিটার কিনলাম।
টিউশন ফাঁকি দিয়ে আমরা এই নতুন যন্ত্রটাকে ভালোভাবে চেনার চেষ্টা করছিলাম।
স্কুলের স্টেজে একবার আমার গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল,সবাই আমার গানের ভীষণ প্রশংসা করছিল। বাড়িতে এসে সবার আগেই মাকে কথাটা জানালাম,ভাবলাম মা হয়তো সাপোর্ট করবেন কিন্তু আমার সেই সৌভাগ্যটা ছিলোনা।মা সাথে সাথে বাবাকে জানিয়ে দেয়;
বাবা তার পরদিনই ওই স্কুল থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় আর সেই সাথে গিটার আর আমার পুরানো বন্ধুগুলোর সাথে যোগাযোগ ও বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু আমি থেমে থাকিনি,আমার স্বপ্ন আমায় তাড়া করছিল।
এস এস সি পরীক্ষার এক মাস আগে একটা টিভি শো'এর অডিশন রাউন্ড চলছিল; খবর পেয়ে আমি ছুটে যাই;
পরপর দুটি রাউন্ডে টিকেও যাই কিন্তু তৃতীয় রাউন্ডের প্রতিযোগী বাছাইয়ের আগে ওখানে গ্রুমিংএর জন্য ২দিন ১রাত থাকতে বলা হলো।
আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে গ্রুমিং এ যোগ দেই।
সন্ধ্যার মধ্যে খবরটা বাবার কানে পৌঁছে যায়।সেদিন রাতেই বাবা আমাকে সবার সামনে থেকে টেনে নিয়ে আসেন।
আমার এতদিনের স্বপ্নগুলো নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।এরপরে মাধ্যমিকের পরীক্ষায় আমি টেনেটুনে বি গ্রেডে পাশ করি।
এরপর ভর্তি হয়ে গেলাম শহরেরই একটা সরকারি কলেজে।
এবার আর আমায় কে আটকায়,আমার যে শিল্পী হওয়া চাই ই চাই...!!
কিন্তু না আছে পকেটে টাকা,না আছে একটা ইন্সট্রুমেন্ট,শিল্পী হওয়ার স্বপ্নটা তাই আবার স্তিমিত হতে থাকে।।
জড়িয়ে পড়লাম রাজনীতিতে।রোজ মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া আসা শুরু করলাম,দাঙ্গায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
অপজিশন পার্টি থেকে বাড়িতে বার বার হুমকি পাঠানো হতো,বাবা আমাকে ডেকে বললেন তোর মতো ছেলের আমার কোনো দরকার নেই।
রাগ করে সেদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই।এরপর মাসে একবার করে বাড়িতে আসতাম;বাকি টাইম পার্টি অফিস,এই হোস্টেল ওই ম্যাচ করে করে কাটিয়ে দিয়েছি।
আমার হঠাৎ মনে হলো আমার এমন কিছু একটা করা দরকার যাতে পার্টির সবথেকে বড় নেতা হওয়া যাবে।
সিদ্ধান্ত নিলাম অপজিশন পার্টির দুটো ছেলেকে পেটাবো;
আমি আমার দলের তিনটে ছেলেকে নিয়ে পরদিন ভোররাতে অপজিশনের দুজনকে প্রচন্ড মারলাম;
পরদিন খবর পেলাম একজন ইন্টারনাল হেমোরেজ হয়ে মারা গেছে।
পার্টি থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হলো,পালিয়ে গেলাম দূরসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের বাসায়।
তিন দিন পরে ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ি।
আমার ছ’বছরের জেল হয়।আর সেই সাথে আমার পড়াশোনার জীবনেরও ইতি ঘটে।

জেল থেকে বের হওয়ার পর বাবা মা ভাবলেন আমাকে বিয়ে দিলে হয়তো আমি ঠিক হবো।
যেই চিন্তা সেই কাজ; জেল থেকে বের হওয়ার এক মাসের মাথাতেই আমাকে বিয়ে দেয়া হলো।
আমার মাথা থেকে গানের ভুতটা তখনো নামেনি।
কিছুদিন পর বাবা আমাকে কিছু টাকা দিলেন ব্যবসা করার জন্য,কিন্তু আমি সেই টাকাগুলো নিয়ে শহর থেকে দূরে চলে যাই।
একটা রুম ভাড়া করি,কিছু ইনস্ট্রুমেন্টস কিনি আর কয়েকটা জুনিয়র ছেলেদের নিয়ে নেমে পড়ি সংগীতের মাঠে।
এদিকে রাতদিন গান নিয়ে পড়ে থাকায় বাড়ির খোঁজখবর আর নেয়া হয়নি।একদিন শুনলাম মা মারা গেছেন,আমি সংগীত ফেলে বাড়িতে ছুটে যাই।দুদিন থাকি আমার স্ত্রীর সাথে তারপর কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ি আমার গন্তব্যে; আসার সময় লুকিয়ে স্ত্রীর গলার হারটাও নিয়ে আসি,পরে সেটা বিক্রি করে যে পয়সা পাই তাই দিয়ে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করি সংগীতচর্চা।
আমার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলো,এর তিন মাস পরে আমার প্রথম ছেলের জন্ম হয়।
এতদিন পর্যন্ত সবাইকে বলতাম আমি ব্যবসা করি কিন্তু এবার বাবাকে আর স্ত্রী মুনাকে বলে দিলাম যে আমি এখনো সংগীতের পেছনে ছুটছি।
একটা ব্যান্ড গড়ার কাজ করছি।
কয়েকমাস পর টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার বাড়িতে গেলাম,এবার মুনা স্রেফ জানিয়েই দিলো ও আর আমার সাথে থাকতে চাচ্ছে না।
আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলো।
এদিকে বাবাও তার সমস্ত সম্পত্তি তার ছোটো ছেলেকে লিখে দিলেন,আর আমাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষনা করলেন।
হারালাম আমার পরিবারটাকেও,ভীষণ একা হয়ে গেলাম।অন্যদিকে ব্যান্ডের ও কোনো উন্নতি নেই।
তাও শেষ চেষ্টা হিসেবে দুটো গানের ক্যাসেট ছাড়লাম বাজারে; একটাও বিক্রি হলোনা...
টাকা নেই,বাড়ি ও নেই একদম নিঃস্ব একটা অবস্থা।
তারপর থেকে একটা হোটেলে কাজ শুরু করলাম হোটেলবয় হিসেবে।দিনের বেলা ওখানে কাজ করতাম আর রাতে নতুন গান বানানোর চেষ্টা।
এমনি করে দুটো বছর কেটে গেলো,এর মধ্যে বাড়ি থেকে বাবা,ছোটভাই,বোন কেউ একটাবারের জন্যে ও আমার সাথে যোগাযোগ করলো না।
কাগজে দেখলাম অনেকগুলো বছর বাদে আবার সেই টিভি শোটা শুরু হবে,অডিশন রাউন্ড চলছে।
ব্যান্ড এর কথা আপাতত ভুলে গিয়ে প্রতিযোগিতায়  নাম দেই অডিশনে টিকেও যাই।আমার মনে আছে সেই প্রোগ্রামের পার্টিসিপ্যান্টদের মধ্যে আমার বয়সটাই সবথেকে বেশি ছিলো;
চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি তবে যৌথভাবে রানার্সআপ হয়েছিলাম।
সেই থেকে একটু আধটু পরিচিতি পেলাম।বছর শেষে আবারো নতুন একটা ক্যাসেট বের করলাম "নেশাতুর চোখ" শিরোনামে।
অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম মানুষ আমাট ক্যাসেট কিনছে,ভূমিহীন ব্যান্ডের গান শুনছে।তারপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।একটার পর একটা শো তে ডাক পাওয়া শুরু করলাম,বেশ সুনাম কুড়লাম।কিন্তু তখনও আমার পরিবার আমার সাথে একবারের জন্যেও যোগাযোগ করেনি।
তারপরের পাওয়াটা আমার জীবনের সবথেকে বড় অর্জন,ভূমিহীন ব্যান্ড পেলো বছর সেরা ব্যান্ডের সম্মাননা।
ওইদিন রাতেই রওনা করি বাড়ির দিকে,বাড়িতে গিয়েও অবশ্য কোনো লাভ হলোনা,বাড়িতে আমার জায়গা হয়নি।
 তারপর গেলাম মুনাদের বাসায়,ছেলে আমার এতদিনে দৌড়াতে শিখে গেছে।
মুনাকে বললাম ছেলেকে আমি নিয়ে যাবো ও আমার সাথেই থাকবে।
তারপরে কি সব আইন কানুনের কথা শুনিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো,ছেলে তার মায়ের সাথেই থাকবে।
বেড়িয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকেও।

আমার জায়গা হলোনা এই শহরের কোত্থাও।
স্বপ্নটাকে আমি ঠিকই ছুঁয়ে দেখলাম কিন্তু ততদিনে আমি ভীষণ একা হয়ে গেছি।
স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমার পরিবার,আমার স্ত্রী আমার সন্তান সবাইকে হারালাম

ভাবলাম এতো বড়ো একটা অর্জনের পর নিশ্চয়ই ব্যক্তি আমি খুব বড় একটা সেলিব্রেশন ডিজার্ভ করি।আর সেটার জন্যই এখন আমি এই টাইগার হিলের উপরে।
সুখ খুঁজছি আমি ,
এত এত প্রশংসা,এত সুনাম,এত অ্যাওয়ার্ড
এ সবকিছুর মাঝে সেটা নেই।
আমি হারিয়ে ফেলেছি সেটা....!!!!

------------------------------------
এরপরের অংশটুকু টিভি রিপোর্টারের।
ব্রেকিং নিউজ: ভূমিহীন ব্যান্ডের প্রধান তরুণ কণ্ঠশিল্পী তুষার,আজ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময় টাইগার হিল থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন........................

Thank you all

--সুখ বনাম স্বপ্ন
--হাসিবুর রহমান ভাসানী

Post a Comment

0 Comments