আমার বাবা একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান।
মধ্যবিত্ত শব্দটা বাদ দিলেই বোধহয় ভালো হয়;
এক কথায় দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন।
অল্প বয়সেই তার বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে মাধ্যমিকের পরেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
তাই এরপর বাবার আর পড়ালেখা করাটা ঠিক হয়ে ওঠেনি।
চাকুরির দু বছরের মাথায় বাবা মাকে বিয়ে করেন।
আর তার দেড় বছর পরেই আমার জন্ম হয়।
আমার জন্মের সময় বাবা মায়ের কাছে থাকতে পারেন নি।চাকুরির কারনে তখন তাকে খুলনা থাকতে হয়েছিল।
তাই বাবা মাকে একটা চিঠি লিখে পাঠান আর তাতে উল্লেখ করে দেন যে,আমার নাম যেন শিউলি রাখা হয়;
পরে অবশ্য জেনেছিলাম,বাবার শিউলি ফুল ভীষণ পছন্দ।
আমার জন্মের ছমাস পর বাবা ছুটি পেলেন,বাবা মায়ের জন্য একটা বাসন্তী শাড়ি আর আমার জন্য ছোটছোট লালরঙা চুড়ি নিয়ে এসেছিলেন।
বাবা আমায় সেই ছোট থেকেই ভীষণ ভালোবাসতেন;মা মাঝেমধ্যে একটু মুখগোমরা করে বাবাকে বলতেন,বাড়িতে আসার পর থেকে এই মেয়ে নিয়েই পড়ে আছে,ঘরে যে আরো দুটো মানুষ থাকে সে খেয়াল কি তোমার আছে..?
বাবা অবশ্য এগুলোতে একদমই কান দিতেন না।
ছোটবেলায় আমার সাথে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিলো,সব বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই প্রথমে মা মা ডাক দিয়ে তার কথা বলার শুরুটা হয় কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পুরো উল্টো,বাবার কোলেই বাবা ডাকের মাধ্যমেই আমার কথা বলার শুরু।
যখন আমার বয়স ছ'বছর এক মাস তেরো দিন তখন আমার মা মারা যান জ্বর আর কাঁপুনি হয়ে।
বাবা তখন নীলফামারিতে পোস্টিং এ।
বাসায় কেবল আমি আর আমার দাদি।
তখন আমি প্রথম শ্রেণীতে পড়ি;তাই মৃত্যু ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ অপরিচিত ছিলো,বাবার কাছে শুনেছিলাম,যখন মা মারা যায় তখন আমি পুতুল খেলায় ব্যস্ত;পুতুলকে শাড়ি পড়াচ্ছিলাম।
মা মারা যাওয়ার পরে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি চাকুরি ছেড়ে দিবেন।দাদী খুব করে নিষেধ করলেও বাবা কারোর কথাই শুনলেন না।
চাকরি ছেড়ে তিনি আমার দিকে মনোযোগ দিলেন।
এদিকে একে তো দরিদ্র সংসার,বাবার সামান্য বেতনের টাকায় মাস চলতো,চাকরি ছেড়ে বাবা এখন বেকার,পকেটের টাকাও ফুরিয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের কোনো ফসলী জমি ছিলোনা তাই বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন অন্যের জমিতে বর্গাচাষি হিসেবে কাজ করবেন।
বলা বাহুল্য,বাবার কাজের শত চাপ থাকলেও কোনোদিন আমাকে স্কুলে দিয়ে আসা আর স্কুল থেকে বাড়িতে আনায় একমিনিট ও বিলম্ব হতো না।
এর তিন বছর বাদে,যখন আমি ক্লাস টু এর শেষদিকে তখন আমার দাদি যক্ষ্মায় মারা যান।
বাবার মাথায় তখন অনেকটা আকাশ ভেঙে পড়ার মতো,এতদিন দাদীই রান্না করতেন বা বাবা কাজে গেলে আমি তার সাথেই থাকতাম।
সেই সময়কার কিছু দৃশ্য আমার এখনো মনে আছে,বাবা রান্না জানতেন না; তাই দাদী মারা যাওয়ার পর মাস দেড়েক আমরা শুধু মাঝেমধ্যে ডিম আর তিন বেলা ভাতের সাথে আলুভর্তাই খেয়েছি।
আমি যেন নাগালের বাইরে না যেতে পারি,পুকুরে না পড়ি এসব ভয়ে বাবা আমাকে প্রায়ই রুমে আটকে রেখে বাইরে কাজ করতো বা দূরে কোথাও কাজে গেলে আমাকে আদিবাসীদের স্টাইলে পিঠের সাথে গামছা দিয়ে বেঁধে সাথে করে নিয়ে যেতেন।
বর্গাচাষ ছেড়ে দেয়ার পর বাবা বাড়িতে বসে তার অল্পকিছু পুঁজি দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন।একসাথে দুইকাজ হবে এতে; আমাকেও সাথে সাথে রাখা যাবে আর বাকি কাজও হবে।
কিন্তু সাত সালের বন্যার পর আমাদের পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যায় আর সবগুলো মাছ মরে যায়।
সেদিনের পুকুরধারে বাবার সেই কান্নার দৃশ্য আমার আজন্ম মনে থাকবে।
বাবা সবসময়ই বলতেন দেখিস তোকে যে বাড়িতে বিয়ে দেবো,সে বাড়িতে তোকে অনেক আদর করবে,আমি জিজ্ঞেস করতাম আচ্ছা বাবা ওরা যদি আমায় না ভালোবাসে..?
বাবা বলতেন,আমার লক্ষী মেয়েটাকে না ভালবেসে থাকতেই পারবেনা।
আমার এটাও মনে আছে,ক্লাস সেভেনে বসে বাবার কাছে আমি একটা ক্যালকুলেটর চাইছিলাম,বাবার হাতে টাকা ছিলোনা,পরদিন বাবা খেয়াঘাটে দিনভর কুলির কাজ করে সন্ধেবেলা আমার জন্য নতুন একটা ক্যালকুলেটর কিনে আনছিলেন।
এমনি করে এস এস সি পাশ করলাম,যেদিন রেজাল্ট দিলো বাবা সেদিন খুশিতে আশপাশের পঞ্চাশ ঘরে মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন।
এরপরে স্থানীয় কলেজেই মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়ে যাই; আর সেখানেই আমার পরিচয় হয় কবীরের সাথে,আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।
উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা শুরু হয়।আমি সবসময়ই চেষ্টা করতাম বাবা যেন কোনোভাবে টের না পায়,নয়তো বাবা ভীষণ কষ্ট পাবে।
একদিন নদীর পাড়ে কবীরের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম,বাবা দেখে ফেলেন।
বাড়িতে আসার পর বাবা টানা তিন দিন আমার সাথে একটা কথাও বলেন নি।
একটা সময় পর বাবার ধারণা হলো আমাকে যদি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেন তাহলে হয়তো আমি জীবনে সুখী হতে পারবোনা,তাই বাবা আমাদের সম্পর্কটাকে মেনে নেন।
সমাজবিজ্ঞান নিয়ে সম্মান ২য় বর্ষে পড়ছি
তখন আমার বিয়ে হয় কবীরের সাথেই।
যেদিন আমায় ওদের বাসায় তুলে নিলো,সেদিন আমার সাথে ওই বাড়িতে যাওয়ার মতো আমার কেউই ছিলোনা।
আমি চলে যাওয়ার পর বাবা মায়ের কবরের পাশটায় বসে অনেক্ক্ষণ কেঁদেছিল।
[পাঠকদের জ্ঞাতার্থে:বাবার কাছে তার মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি তুলে দেবার জন্য নতুন গয়না কেনার পয়সা ছিলোনা,তাই মায়ের বালা,চুড়ি,দাদির নাকফুল এগুলো মিলিয়ে আমার জন্যে একজোড়া কানের দুল আর একটা চেইন কিনেছিল বাবা,
আর এতদিনের আয়ের সব টাকাটাই,তেইশ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন কবীরের হাতে]
বিয়ের প্রথম দুমাস বেশ ঠিকঠাকই ছিলো,কিন্তু এর পরেই কবীরকে ওর বাবা মা চাপ দিতে থাকে যাতে করে আমাকে দিয়ে আামার বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা এনে এই সংসারে দেয় ব্যবসা করার জন্য।
আমি জানতাম আমার নিঃস্ব বাবার পক্ষে এতগুলো টাকা দেয়া কোনোদিনই সম্ভব না।
কবীরকে বেশ হাতে পায়ে ধরে বুঝানোয় ও মেনে নিল;
আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় বিয়ের এক বছরের মাথায়।
আগের সমস্যা টা এরপর থেকে আরো জোড়ালো হতে শুরু করে;
আমার বাচ্চার বয়স যখন দেড় বছর তখন কবীর নিজের থেকেই আমাকে বাবার কাছে টাকা চাইতে বললো।
ও বললো,এখন আামাদের ছেলে হয়েছে, সংসার বড় হয়েছে,তুমি যেমন করেই হোক তোমার বাবার থেকে একলাখ টাকা আনো।
এবার আর আমার কোনে অনুনয় কাজে দিলোনা।
এরপর যেদিন বাড়ি থেকে এই বলে বের করে দিলো যে,টাকা না আনলে তুই ঘরে উঠতে পারাবি না সেদিন খুব ভয়ে বাবার কাছে টাকাটা চাইলাম।
বাবা না করলেন না,বললেন চিন্তা জরিস না মা; আমি বেঁচে থাকতে তোর কিছু হবে না।
তিন দিন পরে বাবা আমার হাতে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে বললো,এটা নিয়ে যা আর বলিস সামনের মাসে পুরোটা পেয়ে যাবে।
বাবার সেদিনের মৃদু হাসির আড়ালের দুঃখটা আমি বুঝতে পারি নি।
বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,বাবা এতগুলো টাকা তুমি কোথায় পেলে..?
বাবা বলেছিলেন,অনেক আগে একজনে ধার নিয়েছিলো সেটাই ফেরত এনে আমাকে দিলেন।
এরপরের তেরো দিনের মাথায় বাবা বাকি ষাট হাজার টাকা নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির।
টাকা পাওয়ার পর এ বাড়ির সবাই আমাকে আর বাবাকে ভীষণ খাতির যত্ন শুরু করে।
এরপরের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল,আমার সংসার বাবার কাজ সবকিছুই।
এর আট মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন খবর পেলাম বাবা নাকি পুলিশের অভিযানে মারা গেছেন।
আমি পাগলের মতো হয়ে ছুটছিলাম বাবার লাশের দিকে।।পরে যেসব কথা জানতে পারি,সেগুলোই আমার পুরো জীবনকে নিমিষেই পাল্টে দিতে বাধ্য করে।
প্রথমত,প্রথমের ওই চল্লিশ হাজার টাকাটা বাবা পেয়েছিলেন বন্দরের একজন ব্যবসায়ীর থেকে বিনিময়ে টানা এক বছর শহর থেকে তার বাড়িতে মাদক পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব;
রাতারাতি এ শহরে এতগুলো টাকা বাবাকে আর কে ই বা দিতো..!!
আর দ্বিতীয়ত যে ষাট হাজার টাকা ওটা বাবা জুগিয়েছিলেন মাছসহ দুটো পুকুর বিক্রি করে আর বাড়িটা তিন বছরের জন্য বন্ধক রেখে।
ওই সংসারের প্রতি এরপর আমার একটা ঘৃনা চলে আসে;
আমি কবীরকে ছেড়ে চলে আসি সেই সাথে আমার দু'বছরের বাচ্চাকেও রেখে
ঢাকায় এক বান্ধবীর কাছে চলে আসি।
পরে টেইলার্স এর কাজ করি আর ছোটো ছোটো কুটির শিল্প এগুলো করেই সামনে আগাই।
এর ছয় বছর পরে আমি নিজেই একটা ছোট প্রতিষ্ঠান খুলি আর বাবার নামে নাম দেই 'করিম স্মল বিজনেস প্লান্ট'
..............নাহ,এরপরে আমার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।
শুনেছিলাম বছর ঘুরতেই কবীর বিয়ে করে ফেলে।
মাঝে মাঝে ছেলের কথা ভীষণ মনে পড়ে;
খুব দেখতে ইচ্ছে হয়।
যাইহোক সব মিলিয়ে এখন একাই আছি;
সুখে নেই এটা সত্য তবে শান্তিতে আছি......!!
0 Comments