আমি এবং কিছু রাত | হাসিবুর রহমান ভাসানী | Hasibur Rahman Bhashani

হাসিবুর রহমান ভাসানী   


নীলসাগর এক্সপ্রেস,সময় রাত ১০.৪৫..... উদ্দেশ্য নগরী ঢাকা।
যাইহোক আর একটু পেছনে ফেরা যাক,
টানা সপ্তাহখানেক পুরোদস্তুর ছুটি কাটিয়ে এবার ঢাকায় ফেরার পালা।
বরাবরের মতোই ট্রেনই আমার প্রথম পছন্দ,সেজন্যই আগে থেকেই টিকিট কেটে রাখা।কাঁধে ব্যাগ,আর হাতে গিটার নিয়ে উঠে পড়লাম আমার কামরায়।
বলে রাখা ভালো,খুব যে ভালো বাজাতে পারি তা কিন্তু না,ওই একটু আধটু  যা পারি সেটাই আমার কাছে অনেক কিছু,এজন্যই কোনো লম্বা সফরে প্রিয় গীটার আমার সাথেই থাকে।
শুরুতে একটু অবাকই হলাম কারন,এই কামরা টা কেমন একটা ভুতুড়ে ভুতুড়ে,জনশূন্য বললেও ভূল হবে না,কারন গুটিকয়েক মানুষ মাত্র।
সাধারণত ট্রেনে ভীড় থাকে এটাই দেখে দেখে অভস্ত্য ছিলাম এতদিন।
যাইহোক,জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম,জোৎস্না রাত,চাঁদটাও আমাদের সাথে সাথেই যাচ্ছে।
অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য আমার চোখে ধরা দিচ্ছিলো,আর আমিও মুগ্ধ হয়েই দেখছিলাম,আর কানে তখন বাজছিলো মেঘদল এর "কিছু বিষাদ হোক পাখি" গানটি....
চলন্ত ট্রেনের জানালা গলিয়ে সোৎস্নার আলো কিছুক্ষণ পর পর ধরা দিচ্ছিলো,আর আমিও ডুব দিচ্ছিলাম প্রকৃতির এই মোহনীয় রুপের চাদরে।
ঘন্টা খানেক পড়ে,রেলগাড়ীর তীক্ষ্ণ শব্দে প্রকৃতির থেকে মনোযোগ হারালাম।
আমাদের কামরায় মোট ৬জন মানুষ,
কামরায় চোখ ঘুরাতেই হঠাৎ একটা জায়গায় গিয়ে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো। একজন ভীষন সুন্দরী ভদ্রমহিলা
না মহিলা বললে ব্যাপারটা বেমানান হবে,মেয়ে বললেই  বরং বেশি জুতসই হবে।
আমার বয়সের ই হওয়ার কথা বা কিছুটা এদিক ওদিক।
 আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে তার সিট।কানে কালো রঙের হেডফোন গুজে আধোঘুম ভাবে বসে আছে।
আমার সৌন্দর্যপিয়াসী চোখ তার সৌন্দর্যটায় কিছুক্ষণ হারিয়ে গেল।ইচ্ছে হলো আলাপ করবার,কারণ প্রকৃতির সৌন্দর্যের থেকে এইমুহূর্তে আমি তার সৌন্দর্যে বেশি মজেছি।
কাভার থেকে গিটার টা বের করে,ইচ্ছে করেই টুং টাং আওয়াজ করতেই আমার দিকে সে তাকালো একবার,পুনরায় শব্দ করলাম, হ্যাঁ এবারো তাকালো।
আমিও বেশ পুলকিত অনুভব করলাম।২য় বারের পর আর সে তাকায়নি আমি গিটারে অনেক টুং টাং করার পরেও।
খানিকটা মন খারাপ হলো।
গিটার ফেলে তার সামনের সিটে গিয়ে বসলাম।সাধারণত আমি খুব জরুরী কোনো কারন ছাড়া  কারো গায়ে পরে কথা বলা পছন্দ করিনা,কিন্তু আজকে সেই অপছন্দের দেয়ালটা ভাঙতে ভীষন ইচ্ছে হলো।আলাপ শুরু করার প্রথম প্রয়াস হিসেবে আমি বললাম
--হাই
বেশ গম্ভীরভাবে তিনিও জবাব দিলেন এই দুটো অক্ষরেই।
-আমি আগ বারিয়ে বললাম আমি রাফি
--'ও আচ্ছা' বলেই তিনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন
আমার কাছে এখন কেমন একটা অপ্রীতিকর লাগলো।
আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বললাম 'কেউ দূর থেকে চাঁদের আলোয় ডুব দেয় আর কেউ ভীষণ কাছে থেকে'
এবার তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন।
নিজের থেকেই বললেন আমি অবনী।
--বাহ.বেশ সুন্দর নাম তো।
আপনার নামটা আমি আগে থেকেই জানি।
--তাই নাকি,কিভাবে?
--শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়
এবার তার মুখে অনেক লম্বা একটা হাসি দেখা গেলো..
বললেন,হ্যাঁ আমিও পরেছি দু বছর আগে।
--তো আপনার ও বুঝি দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে থাকা পাড়ার মতো চুপচাপ স্বভাব?
--মুচকি হাসি দিয়ে বললো কিছুটা।
রাত বারলো আলাপের গভীরতা বাড়লো,
জানতে পারলাম সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে বাংলা নিয়ে পড়ছে।
বিরামপুরে ট্রেনের গতি কমলো,চা অফার করলাম।
একসাথে বসে আছি,দুজন মানুষ,জীবনে কেউ কাউকে এর আগে কখনো দেখিনি অথচ এই শেষ এক ঘন্টাতেই বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো।
তার কথা যেন মুগ্ধতা ছড়িয়েই যাচ্ছিলো আর আমি ও সেটা উপভোগ করছিলাম।
হঠাৎ করে বলেই ফেললাম আপনি যে দেখতে এতটা সুন্দর সেটা কি আপনি জানেন..?
 প্রতুত্তরে বললো হয়তো;তবে এই কথাটার সাথে আমি ভীষন পরিচিত,কারন এই শেষ ৪ ঘন্টায় ও আপনি ছাড়া আরো আটজন আমাকে এটা বলেছে।
রীতিমত অবাক হলাম,বুঝতে পারছিলাম না এর পরে আমার কি বলা উচিত।
আমি বললাম,মানুষ মাত্রই সৌন্দর্যপিপাসু এটা তো দোষের কিছু নয়।
আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,সৌন্দর্যে বিশ্বাস করেন??
--হ্যাঁ,অবশ্যই।কেনো করবোনা।
--সৌন্দর্য বলতে আপনি কি বুঝেন?
ফর্সা ত্বক এটাই তো??
--নাহ।ব্যাপারটা একটু জটিল। সৌন্দর্য ২ প্রকারের হয়।একটা আপনি যেটা বললেন মানে ফর্সা ত্বক আর দ্বিতীয়টা মনের সৌন্দর্য।
--আপনার জানায় সামান্য ভুল আছে,প্রথম টাকে সৌন্দর্য বলে না।ওটাকে মোহ বলে।
বুঝতে পারলাম খানিকটা রহস্য আছে নয়তো যে কোনো মেয়েরই সৌন্দর্যের প্রশংসা করলে তাতে বিরোধ করার কথা নয়।
আমি কিছুক্ষণের জন্য শার্লক হোমস বনে যেতে চাইলাম এই রহস্যভেদ করার জন্য..
--ধন্যবাদ,আমার জানায় যে ভুল ছিলো সেটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য।
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?
--হ্যাঁ নিশ্চয়ই,আর হ্যাঁ কিছু মনে করবেন না রেগে যাওয়ার জন্য।
--শুধু শুধুই কি সৌন্দর্যের প্রতি তিক্ততা জন্মালো?
--তিক্ততা না,এটাই সত্যি।
--আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি আমার কাছে লুকাচ্ছেন।থাক,না বলতে চাইলে জোর করবো না..
--না ঠিক তা নয়,তবে গত ২ বছর আগে আমার বড় বোনের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল,ঠিকঠাক ও হয়েছিল তবে গায়ের রং কালো হওয়ার বিয়ের ঠিক আগের দিন জানিয়ে দেয়া হলো ওরা বিয়ে করতে ইচ্ছুক না,চাইলে ছোট মেয়েকে মানে আমাকে বিয়ে দিতে পারে।খানিকক্ষণের জন্য ঘেন্না হচ্ছিল,বমি পাচ্ছিল কথার আঁচে।
আমাদের সব আয়োজন ততক্ষণে প্রায় করা শেষ হয়ে গিয়েছিল,আমার বড় বোন সেদিন গভীর রাতে উঠোনের জারুল গাছের ডালে বিয়ের শাড়িতেই ঝুলে পড়ে।
সেই থেকে সৌন্দর্য শব্দটার প্রতি আমার তীব্র অনীহা। কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে।
--জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকাও,
দেখো চাদের আলোয় চারদিক টা কেমন ভরিয়ে তুলছে,মন ভালো হয়ে যাবে।
--মরা চাঁদের আলো আমাকে বিমোহিত করে না।
--একবার তাকিয়েই দেখোনা।
--অগত্যা জানালা দিয়ে সে বাইরে তাকালো,আমি বলতে শুরু করলাম..
'তোমার ভেতরকার যত দুঃখ কষ্ট শোক আছে
সবটা কিছুক্ষণের জন্য উজার করে দাও,জোড়ে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার তাকাও চাঁদটার দিকে।চারদিকে কি ভীষণ জোৎসনার প্লাবন।
ঠিক এই মুহূর্তে তোমার আমার মতো হাজারো মানুষ,কিংবা সংখ্যাটা লাখ ও হতে পারে
এই একই চাঁদটার সাথে তার একান্ত দুঃখ ভাগাভাগি করছে কেউবা আবার তার বিশালত্ব থেকে জীবন গড়ার মোটিভেশান নিচ্ছে। দেখো ও কিন্তু ভীষন একা কিন্তু তারপরেও সবাইকে আলোকিত করে যাচ্ছে।
কি বুঝলে এতক্ষণে....
আসলে  জীবন কারোর জন্যই থেমে থাকেনা,আটকেও যায় না।ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষাদগুলো পুষে রাখতে নেই।
তার থেকে বরঞ্চ হাসিমুখে জীবনটাকে উপভোগ করাই শ্রেয়।

অবনী এবার হাসিমুখে বললো,থ্যাংকস।
আপনি আসলেই বেশ দারুন কথা বলেন।
ডাক্তারি না পড়ে বরং বাংলা সাহিত্য বা যুক্তিবিদ্যায় পড়লে আপনাকে বেশ ভালো মানাতো।
রাত এখন ১টা বেজে ১৮ মিনিট।
--ঘুমুবে না?
--নাহ,
--কেনো?
--এইমাত্র না বললেন জীবনে যত পারো সুখগুলোকে লুফে নাও তাই সজাগ থাকছি,ঘুমিয়ে পড়লে এখনকার সৌন্দর্যটা মিস করবো।
--এখনকার আবার কি সৌন্দর্য??
--আপনার কথার মাঝে আমি ভীষণ সৌন্দর্যচ্ছটা খুঁজে পাচ্ছি।
--বেশি খুঁজতে যেওনা।।
--কেনো?
--না,এমনি বললাম।
দুজনের হাসি ঠাট্টায় রাত গড়িয়ে সকাল এলো।
যাওয়ার আগে ও বললো,আপনাকে অনেক বেশ মিস করবো...
-আপনাকেও হয়তো
-হয়তো কেন?
-আমি আসলে এমনই, প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সাথে আলাপ জমাই, কখনো কখনো কারো কারো প্রেমে আমি পরি,আবার কখনো অন্যরা আমার প্রেমে পরে।
কিন্তু জায়গা বদলানোর সাথে সাথে আমি আমার নিজেকেও বদলে নেই,সেই সাথে ফেলে রেখে আসি সব স্মৃতি,হাসি ঠাট্টা আলাপ কিংবা সেইসব প্রেমিকার অবয়ব গুলোও।
আমি আসলে প্রতিদিন আমার আমিটাকে নতুন করে সাজাই,আবার দিনশেষে নিজের হাতেই মুছে দেই।

--আপনি আসলেই অদ্ভুত।
--হুম আমিও সেটাই ভাবি।
যাইহোক,ভালো থাকবেন।
অবনী চলে গেলো আমিও কমলাপুরেই ফেলে রেখে এলাম অবনী সর্বস্ব।

'আমি এবং কিছু রাত'
'হাসিবুর রহমান ভাসানী'

   

Post a Comment

0 Comments