আমার সর্বশেষ ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ | হাসিবুর রহমান ভাসানী | Hasibur Rahman Bhashani

Hasibur Rahman Bhashani

হাসিবুর রহমান ভাসানী  


পাগলাগারদ থেকে ছাড়া পেয়েছি এ মাসের ২ তারিখে,বৃহস্পতিবার।
তারপরদিন অর্থাৎ শুক্রবার ঠিক সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এক ভদ্রলোক আমার দড়জায় কড়া নাড়লেন।
উশকুখুশকু চুল,মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি  গোঁফ ভর্তি। জিজ্ঞেস করলাম কি চাই?
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন 'আমি কথা বেচা কেনা করি' তাই আপনার কাছে আসা।
আশ্চর্য লোক তো ।
আপনি ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন,তাড়াতাড়ি বিদায় হন।
ভদ্রলোক বললেন,আমাকে একজন পাঠিয়েছেন।খানিকটা আগ্রহ দেখালাম তখন।
কিন্তু কে পাঠিয়েছে সেটা বললো না,শুধু এটুকুই বললো ইন্টারভিউ শেষে পরিচয় দেবো।যদি কিছু মনে না করেন,আপনাকে কিছু অগোছালো প্রশ্ন করবো,তারপরেই চলে যাবো।
আচ্ছা,শুরু করা যাক।

--ভালো আছেন নিশ্চয়ই..?
--না থাকার খুব একটা কারন দেখছিনা।
আসলে বহুদিন যাবৎ এ জাতীয় কথা কেউ জিজ্ঞেস করেনা।
আর আমি ভালো না থাকলেও কারোরই দুপয়সা যাবে আসবেনা।
'মাফ করবেন আমি একটু বাচাল টাইপের তাই কারোর কাছেই ইন্টারভিউ দেইনা,অবশ্য কেউ কখনো নিতেও আসেনি।'
--আচ্ছা
--বাসায় কেউ থাকেনা আপনার সাথে?
-- একসময় থাকতো ক'জন বন্ধু,এখন থাকেনা।বড্ড উন্মাদের সাথে কেউই থাকতে চায়না,আশা করি সেটা আপনার ও অজানা নয়।
--হুম।এখন ও প্রেম করছেন?
--হ্যাঁ
--আগেও তো প্রেম ছিল নিশ্চয়ই,তো কোন সময়টা বেশি ভালো ছিলো তখনকার না বর্তমানটা
--ছিলো,
মাঝখানের সময়টা।
--কেনো?
--আমি মনে করি প্রেমহীন মানুষ স্বর্গের প্রথম ধাপে বাস করে।
--প্রেম নিয়ে আপনার বক্তব্য কি?
--একটা গোলকধাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আর এটা ঠিক তখনই টের পাওয়া যায় যখন প্রেমের ঘোরটা কেটে যায়।
সত্যি বলতে আমি প্রেমে বিশ্বাসী নই।
--মাত্রই যে বললেন,এখনো প্রেম করছেন..
--করছিতো,পাগলাগারদের এক ঝাড়ুদারে সাথে।
তবে,আসার আগে বলে এসেছি,কয়েকদিন ঠিকঠাকভাবে ঘুমাও তাহলে তোমার ঘোর টা কেটে যাবে,গত কয়েকরাত ঘুমাওনি চোখ লাল হয়ে আছে তাই তোমার স্মৃতিভ্রম হয়েছে।
আমি আসলে,কখনোই কারোর ছিলাম না।
--সে কিছু বলেনি...
--বলেছিল হয়তো,খেয়াল করিনি।
অবশ্য এতে আমার কিছু যায় আসে না।
আমার অগণিত প্রেমিক,এইতো শেষবার একজন প্রেমিক ই আমাকে পাগলাগারদে দিয়ে আসলো।
পাগলাগারদ ও আমাকে বেশিদিন রাখেনি।আমি নাকি মিছেমিছি পাগলের ভান ধরে আছি।
আসলে আমি খুঁজছি,সেই কয়েকযুগ আগে থেকে..কিছু একটা খুঁজছি অথচ সেটা আমার কাছে ধরা দিচ্ছেনা,
বারবার ই আমাকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে..
--কি সেটা..
--শান্তি।
--কি রং পছন্দ আপনার?
--কালো।
--কেনো?
--পৃথিবীতে তো এই একটামাত্র রং ই আছে যেটা আমার সাথে যায়।
একটা সময় মানুষের জীবন ভীষণ রঙিন থাকে,বাহারি রকমের রংয়ের আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে।
আর যে মরে যায় তার জন্য ই শুধু এই কালো রঙটা বরাদ্দ,যেখানটায় এসে সব রং, সব আলো নিভে যায়।
--আপনি তো জীবিত..
--কই,আমিতো দেখছিনা।এই তো গত ২০এ জুন আমার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী গেলো।
কত মানুষের ভীড় জমলো,আপনাকে তো দেখিনি।

ভদ্রলোক ততক্ষণে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠলো

--আচ্ছা,আপনি তাহলে মৃত,সেটাই তো বলতে চাচ্ছেন?
--হ্যাঁ
--তো কেনো আট বছর আগে মরলেন কেনো আপনি?
--মরিনি,আমাকে মারা হয়েছে ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে...
--কারা?
--ওই যে আমার প্রেমিকেরা।
--ভারী মুশকিল লোক তো দেখছি আপনি।
আচ্ছা প্রেমিকের মানে বুঝেন আপনি?
--কেনো বুঝবোনা,একদল সুবিধাবাদী ঘাতক।স্বার্থ হাসিল করার জন্য এসে খুন করে চলে যায়.
--তো ক'বার খুন হয়েছেন আপনি?
--৩বার।
--ঘৃনা করেন আপনার খুনিকে?
নাতো,ভয়ানক ভালোবাসি। এক একটা খুনিকে আমার মধ্যে লালন করি।যতবার ই যার হাতে মরি,তাকেই অন্তরে লালন করি।আমার ভেতরের খুনিগুলোকে বড় করছি বাঁচিয়ে রাখছি যাতে একদিন ওরা আমার মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়।

--ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন?
---ভুলেও না,এই শব্দগুলো ভীষন আপেক্ষিক,যখন যার দরকার পরে তখন সে এমন এক একটা শব্দের আবিষ্কার করে।

--শেষ কবে কেঁদেছেন?
৮ বছর আগে,ওই যে শেষবার যখন খুন হলাম..
আসলে কান্না জিনিসটা দিয়ে ম্যাচিউরিটির লেভেল মাপা হয়.আমি যেহেতু এখন বেঁচে নেই তাই ম্যচওউরিটির প্রশ্ন করাটাই অবান্তর অথবা বলতে পারেন ম্যাচিউরির সর্বোচ্চ সীমাও অতিক্রম করে গেছি।
--চুমু খেয়েছেন কখনো?
--হ্যাঁ,৯৫৬ বার।
--হিসেব রেখেছেন?
--হ্যাঁ এটাই তো পুঁজি।এক একটা চুমু আমার কাছে এক একটা ফুটপ্রিন্ট।এগুলো দেখেই তো আমার খুনিদেরকে চিনি।
--আবেগ শব্দটার সাথে কখনো সাক্ষাৎ হয়েছে?
হ্যাঁ ভীষণ বিশ্রি একটা ব্যাপার।
অনেকটা নীরব ঘাতকের মতো।এই যে আবেগের বশবর্তী হয়েই তো আমি প্রতিবার আমার এক একজন খুনির সামনে নিজেকে শপে দিয়েছি।
--আচ্ছা আপনার কছে জীবন মানে কি?
একটা অনুভূতি।
যতক্ষণ এটা আছে ততক্ষণ তুমি বেঁচে আছো,ঠিক যখন ফুরিয়ে যাবে,পারতপক্ষে তুমি তখন থেকেই মৃত।

এই যে আমার অনুভূতিরা মরে গেছে বলেই আমি আজ মৃত।

--প্রতিশোধে বিশ্বাস করেন?
করি বলেই তো আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমাকে।
আমার কাছে মনে হয়,জগতের প্রতিটা প্রানীই কেবল প্রতিশোধের জন্যই বেঁচে থাকে।
আর যখন সে ব্যর্থ হয় তখন সে প্রতিশোধগুলো স্রষ্টার কাছে জমা করে দেয়।

--আমার সময় কম।আপনার জন্য আমার আর ৫ মিনিট বরাদ্দ।

--আচ্ছা তারপর কি করবেন?
মানে,৫ মিনিট পরে কি করবেন?
--নিজেকে বাঁচানোর নতুন একটা উপায় খুঁজবো
--কিভাবে?
--আর একটা গল্প সাজাবো,শেষবারের মতো।
--কি গল্প?
--নতুন একটা প্রেমের গল্প।
--তবে এই শহরে নয়।
অন্য কোনোও যেখানকার আকাশ কখনো মেট্রোর ধোঁয়া অব্ধি দেখেনি।
--আপনি তো প্রেমে বিশ্বাসী না??
--হ্যাঁ সেজন্যই ভাবছি অন্য কোনো নাম দেবো,একটা নতুন শব্দ খুঁজছি।
যেটা 'প্রেম' শব্দটার মতো এতটা বিশ্রী দেখতে হবে  না, খুব বেশি সাধারণ আর জৌলুসহীন হবে।
--তো কে আপনার সেই মানুষ?
--জানিনা।খুঁজছি।
তুমি তো দেখছি বড্ড সিরিয়াস হয়ে গেছো,রসিকতা করছিলাম..
আসলে,ভেতরে তীব্র দাবানল থাকলে আর যাই হোক সম্পর্ক হয়না,তার স্পর্শে পুরে ছাই হয়ে যায় আশেপাশের সবকিছু।

--বাঁচার ইচ্ছা হয়না কখনো?
ভীষণ। গতকাল মাঝরাতে তীব্র ইচ্ছে করছিল আবারও বেঁচে উঠি একবার।আবারও ধরা দেই নতুন কোনো খুনির কাছে
কিন্তু ওই যে প্রতিশোধের দোকান খুলে রেখেছি ভেতরে,তাই এখানে খুনিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
--শেষ ইচ্ছে আছে কি?
--ছিল, নথুরাম গডসে কে দেখার।
--কেনো?
--কিছুক্ষণ আগে যে বললাম ভেতের ভেতরে আমার খুনিদের কে বড় করছি।
তার সাথে দেখা হলে,মেপে দেখতাম কে বড় খুনি উনি নাকি আমি যাদের হাতে এতকাল খুন হয়েছি তারা।

--আমার ৫ মিনিট সময় শেষ হয়েছে। ধন্যবাদ।

--এই যে আপনার পরিচয় টা দিয়ে যান,অন্তত এটা বলে যাবেন তো যে কে আপনাকে পাঠিয়েছে।
ভদ্রলোক একটু মুচকি হাসলো আরপর কিছু না বলেই চলে গেল..
আমি একটানা তাকিয়ে রইলাম।

বারান্দায় হঠাৎ দাড়কাকের প্রচন্ড চিৎকারে চমকে উঠে বিছানায় বসলাম,
কতক্ষণ ঝিম ধরে বসে আছি,কেনো জানি হঠাৎ,ভয় লাগলো মৃত্যুভয় বলা যেতে পারে।জানালা গলিয়ে সূর্যের আলো এসে গায়ে পড়ছে।পুড়ানো রংচটা দেয়াল ঘড়িটা জানান দিলো সকাল সাড়ে সাতটা।
দরজা জানলা চেয়ার সব যেমন ছিল কাল রাতে ঠিক তেমনটাই আছে।
তাহলে এতক্ষণ যে ভদ্রলোকের সাথে কথা বললাম সেটা কি আসলেই আমার স্বপ্ন ছিলো নাকি নিছকই কল্পনা বুঝতে পারছিনা ঠিক।
 বিছানা ছেড়ে আয়নার কাছে যেতেই আমি কেমন একটা হকচকিয়ে উঠলাম,গত রাতের স্বপ্নটাকে আবার বের করে আনার চেষ্টা করলাম;
আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম সেই উসকো খুসকো  চুল,খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোফের লোকটা অবিকল আমার মতো দেখতে।
তার মানে কি আমিই আমার প্রশ্নকর্তা ছিলাম।

বুঝতে পারলাম ডায়াজিপামের ঘোরেই এসব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন আমাকে তাড়া করছিল।

বাইরে বেরোলাম,হঠাৎ করেই মাকে ভীষণ মনে পড়লো।
ছোটোবেলায় আমার প্রতিটা দুঃস্বপ্নেই মাকে ঝাপটে ধরে থাকতাম।
খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,দোকানের দিকে রওনা দিলাম,অদূরে ভীষণ গাঢ় একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে,আমি এগোলাম।
 কিছুদূর যেতেই জানতে পারলাম কিছুক্ষণ আগে এক ভদ্রলোক মারা গেছেন,
সম্পর্কে তিনি আমার মাধ্যমিকের শিক্ষক ছিলেন।

একটা দুঃস্বপ্ন,একটা দাঁড়কাক আর একটা মৃত্যু।
সবটা মিলিয়ে আমার আজকের সকালটা ভীষন বাজেভাবে শুরু হলো
জানিনা রাত অব্ধি আরো কতো কি ঘটে.........

"আমার সর্বশেষ ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ"
প্রশ্নকর্তা : আমার অবচেতন মন ।
উত্তরদাতা: আমার সত্তা।
আর গল্পটি লিখেছেন আমি নামক সেই খোলসটা যা আপনার চোখে বাস্তবিক একজন মানুষের অবয়ব।


   

-আমার সর্বশেষ ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ
-হাসিবুর রহমান ভাসানী 

Post a Comment

0 Comments