হাসিবুর রহমান ভাসানী |
আমি মেধা,বয়স ৪১,পেশায় চিকিৎসক নিউরোলজিস্ট;ফ্রান্সের একটা নামী হাসপাতালের কনসালট্যান্ট। আর এটা আমার গল্প।
যখন আমার বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ২৫বছর।
সদ্য ইন্টার্নি শেষ করেছি তখন।
আর যার সাথে বিয়ে হয় ওর নাম রিদ্ধি।আমরা একই সাথে পড়তাম।
মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষ থেকে আমাদের সম্পর্ক।
আর সেটা পরিণতি পায় পাঁচ বছরের মাথায় গিয়ে বিয়ের মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই তখন তরুন বয়স আমাদের;আমরা অত্যন্ত খুশি ছিলাম।
বাড়িটাকে কদিনেই মনে হচ্ছিল যেন একটা স্বর্গ।
আমরা একসাথে একই হাসপাতালে কাজ করতাম।
তাই দুজনের একই সময়ে যাওয়া আসাটায় প্রেম যেন বিয়ের পর আরো একধাপ এগিয়ে গেল।
ওর বাবা নেই,মা আছেন;যথেষ্ট ভালো মানুষ,আমাকে তার নিজের মেয়ের মতো করে দেখতেন।
দেখতে দেখতে বেশ ভালোভাবেই সময় চলে যাচ্ছিলো আমাদের;
সপ্ন দেখছিলাম আমাদের একটা মেয়ে হবে,নাম হবে রিধা;রিদ্ধির রি আর মেধার ধা নিয়ে রিধা;
এমনি করে আমাদের বিয়ের আড়াইটা বছর চলে গেলো,আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের এখন সন্তান নেয়ার উপযুক্ত সময়।
এরপরে হঠাৎ একদিন বৃহস্পতিবারে বিকেলে ডিউটিরত অবস্থায় আমি বেশ অসুস্থ পড়ি।
আলট্রাসনো করায় রেজাল্ট আসলো ওভারিয়ান টিউমার।
আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম,তারপরও ভাবলাম রিদ্ধি তো আমার পাশেই আছে সুতরাং ভয় পাওয়াটা অবান্তর।
পরের মঙ্গলবারে আমার অপারেশন হলো;ডাক্তার জানিয়েই দিলেন আমার দ্বারা আর বাচ্চা নেয়া সম্ভব নয়।
সেদিন আমি প্রচন্ড রকম সাহস হারিয়ে ফেললেও রিদ্ধিকে পাশে পেয়ে ভয়টাকে চাপিয়ে রাখছিলাম।
পনেরো দিনের মাথায় আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরি।
সেদিন সন্ধায়ই আমি রিদ্ধির মাঝে কেমন একটু অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করি।
কেমন একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল,
জিজ্ঞেস করলাম শরীর খারাপ,বললো জানি না।
ভাবলাম রাগ করেছে হয়তো পরে ঠিক হয়ে যাবে।
পরদিন দুপুরে কল দিলাম,একবার দুবার না ছয়বার।
ষষ্ঠবার রিসিভ করেই চেঁচিয়ে বললো,ডিউটি করছি জানো না,এত কল দেয়ার কি আছে,আমি কি মরে গেছি।
আমি আর কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দেই।
তখন আমার ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করে,আমি কেমন যেন পায়ের নিচ থেকে একটু একটু করে মাটি হারাচ্ছিলাম।
এরপর থেকে ও আমার কথা তো শুনছিলইনা,অনেক চেষ্টা করেও ওকে ঠিক করা গেল না।
একদিন বাড়িতে নেশা করে ফিরলো রাত ১১টার দিকে এদিকে আমি যে সন্ধ্যা থেকে কল দিয়েই যাচ্ছি তার কোনো পাত্তা নেই।
বাসায় আসার পর আমি একটু রাগ দেখিয়ে কথা বলায় ও আমাকে বেশ মারধর ও করে।
এমন করে ছ মাস কাটলো।
সংসারে অশান্তির আর শেষ নেই তখন।
মনে হচ্ছিল আমি নরকের মধ্যে আছি।যে মানুষটা আমার জন্য এতটা পাগল ছিলো,যে জীবনে কখনো আমার দিকে চোখ গরম করেও একটা কথা বলেনি সে আজ আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।
রাত হলে দুটো মানুষ পাশাপাশি শুয়ে থাকি,একদম নিশ্চুপ,
মনে হয় যেন দুটো লাশ পাশাপাশি পড়ে আছে।
ওর অবজ্ঞাগুলো আর নিতে পারছিলাম না,ওর কাছে যে এখন আমি বোঝা হয়ে আছি সেটা বুঝতে আমার আর বাকি রইলো না।
ঘরের মধ্যে গুগল থেকে ডাউনলোড করে প্রিন্ট করিয়ে হাজার হাজার বাচ্চাদের ছবি টানিয়ে রাখছে;বন্ধু বান্ধবদের ছেলেমেয়ে এমনকি পাড়ার বাচ্চাদের ও যখন তখন ঘরে নিয়ে আসছে।
রাত্রিবেলা আমি ওকে বেশ নরমভাবেই বললাম দেখো তোমার একজন সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার।
সেদিন ও আমায় এমন একটা থাপ্পড় দিয়েছিলো,যে ওর হাতের ৫টা আঙুলের ছাপ আমার গালে বসে যায়।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে সারারাত কেঁদেছিলাম ওইদিন,আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি ও।
আমি হিসেব রেখেছি আজ অব্ধি ও ২৩ বার আমার গায়ে হাত তুলেছে;তার মধ্যে আমার অপারেশন এর পর থেকে এখন অব্ধি একুশবার।
আমি বুঝতে পারলাম এভাবে আর থাকা সম্ভব নয়।
ওর মা আমায় বেশ আদর করলেও তাতে বিশেষ লাভ হয়নি,কারন রিদ্ধি তার কথার তোয়াক্কা করতো না মোটেই।
এরপর চিন্তা করলাম,এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো;
তাহলে বোধহয় ওর আমার প্রতি কিছুটা হলেও মায়া জন্মাবে,আবার আমায় নিতে আসবে,সরি বলবে।
কিন্তু এরপরের তিন মাসে ও আমায় কল তো দূরে থাক একটা টেক্সট ও দেয়নি।
অনেকবার মনে হয়েছিল আমার মরে যাওয়াটা ভীষণ জরুরী,কিন্তু আমি সেটা পারিনি।
আমি এরপর সিদ্ধান্ত নেই দেশ ছাড়ার,ফ্রান্সে চলে যাবো।
ওখানে একটা হাসপাতালে কাজ নেই,ছয় মাস পরে খবর পাই ও আরেকটা বিয়ে করেছে।
[পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি,যখন আমি ফ্রান্সে চলে যাবো তার পূর্বে আমার সকল নিকটাত্মীয়রা বলেছিলেন তুই ওকে ডিভোর্স দিয়ে যা।নয়তো তুই ওর মায়া কাটিয়ে উঠতে পারবি না,জীবনে আগাতে পারবিনা; যেদিন আমি ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্তটা নেই তার পরদিন সকালের ঘুমটাই ভাঙে পিয়নের ডাকে।
খামভর্তি একটা কাগজ,আর তাতে ডিভোর্স পেপার ও পাঠিয়েছে।আমার কিছু আর করার ছিলোনা,আমার দম আটকে আসছিলো,এরপরদিন বিকেলের ফ্লাইটেই এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ ছাড়ি]
বিদেশে গিয়ে আমি চাইতাম যেন বাকি জীবনটা ওকে আমি প্রবলভাবে ঘৃণা করে বাঁচি,
কিন্তু স্রষ্ঠা আমায় কাউকে প্রচন্ড ঘৃণা করার শক্তিটা দেননি।তাই এতকিছুর পরেও ওকে আমি ভুলতে পারিনি একমুহূর্তের জন্যেও;
আস্তে আস্তে ওর খোঁজ নেয়া বন্ধ করে দেই।
এরপর এগারোটা বছর কেটে যায়,আমি আর কাউকে ওভাবে
ভালোবেসে উঠতে পারিনি বা চাইওনি।
এরপরের ঘটনাটা ছিলো আগস্টের মাঝামাঝি সময়,১৫ তারিখে।
তার আগের দিন টানা ১৯ ঘন্টা ডিউটি করে দু'দিনের জন্য ছুটি নিয়েছি।
সারাদিন ঘুমানোর পর বিকেলে বেরোলাম কফি খেতে জেভিয়ার্স পার্কের ওখানে।
আমি কফি হাতে পার্কের একটা বেঞ্চে বসে হেডফোনে গান শুনছিলাম হঠাৎ আমার নজর পড়ে পূর্ব পাশের তিন নম্বর বেঞ্চিতে কালো রঙের একটা টি শার্ট পড়া হালকা দাড়ি গোফ সম্বলিত একজন ভদ্রলোকের দিকে।
সাদা চামড়া নয় হতে পারে ইন্ডিয়ান কিন্তু পরক্ষণেই মুখের গড়ন দেখে লোকটাকে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
বলে রাখি ক্লাস সেভেন থেকেই আমার মায়োপিয়া,দূরের জিনিস দেখতে পাই না।
বেশ আগ্রহ নিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম; ভদ্রলোক আমাকে দেখে দাঁড়ালেন,চোখ থেকে সানগ্লাস টা নামালেন।
কিছুক্ষণের জন্য আমি স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। কি বলব কি বলবনা ভাবতেই নিজের থেকেই বললো,গত পরশু আমি ফ্রান্সে আসি।আমার চোখমুখে তখন তীব্র ঘৃণা ঝরছিলো;
-বললো এখানেই একটা হাসপাতালে জয়েন করেছি শুনলাম তুমিও নাকি ওখানটায় কাজ করো।
--জেনেশুনে কেনো তুমি আবারো এখানে আসছো,কেনো আমার হাসপাতালেই যোগ দিয়েছো..?
তুমি কি চাও...?
আমাকে কি পৃথিবীর কোথাও শান্তিতে মরতেও দেবে না..?
চলে যাও নয়তো আজ,এক্ষুনি আমি রিজাইন লেটার দিয়ে চলে আসবো।
--মেধা প্লিজ আমার কথাটা শোনো,
--আমার সময় নেই,বাই।
আমি চলে আসতে চাইলাম ও পেছন থেকে আমার হাতটা টেনে ধরলো;
এবার আমিই পেছন ঘুরে ওকে চড় মারলাম একটা,
এ জীবনে এটাই রিদ্ধিকে দেয়া আমার প্রথম এবং হয়তো শেষ চড়।
আমি বললাম তোমার জন্য তিন মিনিট সময় বরাদ্দ,যা বলার বলে চিরজীবনের জন্য তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও।
রিদ্ধি বলতে শুরু করলো,
--তুমি যাওয়ার পরে আমি বিয়ে করি,
--জানি,তারপর বলো। (আমার শরীর তখন রাগে জ্বলছে)
--আমাদের একটা মেয়ে হয়,ওর নাম রেখেছি মেধা।
ওর মা গত বছর একিউট লিউকেমিয়ায় মারা যায়।
--তো আর একটা বিয়ে করো;
ও কোনো জবাব দিলো না,কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমি ওখান থেকে চলে এলাম।
বাসায় এসে সারারাত ঘুমাতে পারি নি।
প্রবল ঘৃনার মধ্যেও ওর জন্য কোথাও যেন সামান্য একটু মায়ার জন্ম নিলো।
সেদিনের রিদ্ধি আর আজকের রিদ্ধির মধ্যে অনেক পার্থক্য।
আজ যাকে দেখলাম সে ভীষন গম্ভীর,আহত আর একা।
যাই হোক চাকরিটা আর ছাড়িনি;
প্রথমে মাঝে মাঝে দেখা হতো তারপর ওর ডিউটি শিফট বদলে যায়,এখন রোজ দেখা হয়,সামান্য কথাও হয়।
.............................................
একবছর যাবৎ কাজ করছি একসাথে,এখন আর ওর প্রতি ওরকমভাবে ঘৃণা জাগে না,
কেন যেন আজকাল ওর কাছে ফিরে যেতে আমারও ভীষণ ইচ্ছে হয়।
এই ডিসেম্বরই ও চলে যাবে।
আমায় ডেকে বললো,কাল ইভিনিং এ হাতে খানিকটা সময় রেখো,কথা আছে।
বিকেলের শেষ রোদ্দুরে সেইন নদীর পাড়ে আমারা দুজন কফির কাপে চুমুক দিলাম।
সূর্য তখন পাল্লা দিচ্ছে ডুবে যাওয়ার জন্য।
ও আমায় বললো,
--মেধা,যদি সবকিছুই আগের মতো থাকতো.!!
--তুমিইতো চাওনি সেদিন।
--তা ঠিক,জানো আমাদের সেই দিনগুলোকে বড্ড মিস করি; ওয়ালেটে এখন সবসময় দুটো মেধার ছবি থাকে।
একটা আমার মেয়ে আর অন্যটা তুমি।
তুমি তো জানো আমি কেনো এসেছি এতবছর পর এখানটায়,যদি অভয় দাও একটা কথা বলতে চাই,অনেকদিন ধরেই বলবো ভাবছি কিন্তু সাহস হচ্ছিলো না।
(আমি আমার সেই কৈশোরে ফিরে গেলাম,ও ঠিক এমনই একটা কথা বলেছিল সেদিন কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তাটায়,ঠিক এমনভাবেই প্রপোজ করেছিলো আমায়)
আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বলা শুরু করলো
--মেধা আমি চাচ্ছি....
আমি ওকে থামিয়ে দিলাম
--আর একটা শব্দ ও না।
ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
'কিছু সময় ফ্রেমে বাঁধানোতেই ভালো মানায়'
(মন তো চাইছিলো যে ওর সাথে ফিরে যাই...
......কিন্তু নাহ; থাক না কিছু গল্প... অসম্পূর্ণ..
জীবনে কখনো কখনো কিছু মূল্যবান জিনিস নিতে নেই ।।।
আমি বরং আমার সেই রিদ্ধিকে নিয়েই বাঁচি..!!)
এয়ারপোর্টে অব্ধি ওকে পৌঁছে দিলাম।
--নিজের যত্ন নিও,মেয়ের খেয়াল রেখো আর ভালো থেকো..
উইশ ইউ এ বিউটিফুল লাইফ বলতে বলতে কখন যে নিজের চোখের কোনে একফোঁটা জলের জন্ম নিলো টেরই পাইনি।
এই জলটা ভালোবাসার নয়,ঘৃনার ও নয়,
এটা সমস্ত জরা,মৃত্যু,ভালোবাসা কিংবা ঘৃনার ঊর্ধ্বে।
0 Comments