মুখোশের আড়ালে | হাসিবুর রহমান ভাসানী | Mukhosher Arale | Hasibur Rahman Bhashani |

বাইরে ভীষণ পলাশ বৃষ্টি
রক্তিমতায় ছুয়ে গেছে চারদিক
শত শত মানুষ ভীড় জমায় প্রতিদিন,
নতুন নতুন গল্পের সূচনা হয় ঠিক এখানটায়,আমার বারান্দা থেকে বেশ কাছেই পলাশের বন,বন বললে অবশ্য ভুল হবে তবে অন্তত অর্ধশত গাছ তো হবে নিশ্চয়ই,
সদ্য বিয়ে হয়েছে আমার,স্ত্রীর বারংবার অনুরোধই নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়ে তার সাথে বেরোলাম।মিনিট পাঁচেকের পথ মাত্র।ওর অবশ্য আবদার ছিল হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে,কিন্তু আজন্ম নীল রঙের প্রতি যার এতটা টান,সে কি করে হলুদ পড়ে।একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ে ও হাঁটছে ঠিক আমার বামপাশটাতেই,মাঝে মাঝে আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল জড়ানোর একটা বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে বেচারি।বুঝতে পারছি আমি কিন্তু না বোঝার ভান করে হাঁটছি।ওর একটা আফসোস রয়েছে,আফসোস বললে ঠিক ভুল হবে,চাপা ক্ষোভ,
আমি কখনো ওকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরিনি বলে।
আজ হঠাৎ ওকে জিজ্ঞেস করলাম,বিনু তুমি আমায় কতটা জানো;অবলীলায় উত্তর দিল স্ত্রী হিসেবে যতটা জানা দরকার ঠিক ততটাই।ভীষণ হাসি পেল আমার,তবে মুচকি হাসলাম;কখনো কোনো কিছুতে আমি কষ্ট পেলে কিংবা নিজের নামে বেনামি কথা শুনলে আমার হাসি পায়,এটা নতুন না বছর পাঁচেকের রোগ।যেখানে মানুষ কষ্ট পেলে কাঁদে,আমি সেখানে হাসি,ব্যাপারটা অদ্ভুত কিন্তু আমার দর্শন ঠিক এমনই।একটা সময় অল্পতেই  ভীষণ কাঁদতাম,তারপর সময় গড়ানোর সাথে সাথে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্যই খোলসটা বদলে ফেললাম,কান্নাটাকে হাসিতে রুপান্তরিত করলাম,ঠিক সেই থেকেই আমি এমন।
দুরে একটা বেঞ্চি পাতা আছে,সেটাকে উদ্দেশ্য করেই হাঁটা,পৌঁছুলাম।
পাশাপাশি আমরা দুজন বসা,একজন ভীষণ ভালবাসার তৃষ্ণা নিয়ে আর অন্যজন নির্বাক,নির্মোহ,অনেকটা প্রাণহীন জড় বস্তুর ন্যায়।ওর চাঞ্চল্য আর আমার প্রতি চাপা ক্ষোভ দেখে মনের মধ্যে একটা কথা খেলা করলো,'যেই নদী বহুকাল আগেই মরে গেছে,কি লাভ সেই নদী খনন করে,সেখানে তো কত যুগ আগেই স্রোত স্তিমিত হয়ে গেছে।'
একটা সময় ছিলো তখন সবে ভার্সিটি লাইফের শুরু,রাত জাগা আড্ডা শেষে ৩.৩৫ এ শেরেবাংলা হলের ছাদে আমি আর আমার বন্ধু,ও ওর বান্ধবীর সাথে আলাপে মত্ত,আমি বেকার বসে আছি।মাথায় একটা প্রশ্ন তখন বেশ ঘুরপাক খাচ্ছিলো,আমি যদি ঠিক এখন হারিয়ে যাই,নিখোঁজ হয়ে যাই,তাহলে এমন কি কেউ আছে,যে আমাকে খুঁজবে,আমার অপেক্ষায় যুগ যুগ কাটিয়ে দেবে।ব্যাপারটা একটা সময় আমাকে ভীষণ পোড়াতে শুরু করলো।
আমি শুরু করলাম আমার সেই কল্পনার প্রিয় মানুষটাকে খোঁজা,হ্যাঁ ছ'মাস যেতে না যেতেই জুটেও গেলো,তবে শহরটা ভিন্ন,আমার থেকে ৮ ঘন্টার দূরে।
কখনো কখনো ভালোবাসা দূরত্বটাকেও হার মানায়, আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিলো।প্রতি মাসের টিউশন থেকে জমানো টাকা দিয়ে তার জন্য হাজারটা পছন্দের জিনিস কিনে নিয়ে যাওয়া ছিলো আমার নিত্যকার অভ্যাস।আমি যেমনটা চাইতাম ও ঠিক তেমনটাই ছিল।কোনো আবদার নেই,চাহিদা নেই,শান্ত,অথচ বেশ চঞ্চল আর তার থেকেও বড় আমার ভালোবাসার কাঙাল ছিলো,
ঠিক আমার কল্পনার মতো।যত দিন যাচ্ছিলো আমারা ঠিক ততটাই ডুব দিচ্ছিলাম আমাদের ভালোবাসার সমুদ্রে।
স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম একটা নতুন সংসারের,কিন্তু  ওই যে শুরুতেই একটা শব্দ বললাম ভীতু,বাঙালি মেয়ে,সমস্যাটা ঠিক এখানেই কারন,এদের যে পাত্রেই রাখা হোক না কেনো সেই পাত্রেরই আকার ধারণ করতে পারে।
আমি ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষ থেকে ৪র্থ বর্ষে পা দিয়েছি,আমাদের জমজমাট প্রেমও ৪টা বসন্তের মুখ দেখল ততদিনে।
তারপর,কোনো কারন ছাড়াই হঠাৎ করে একদিন বিকেলে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো,
ওর সাথে যোগাযোগের যতগুলো মাধ্যম আমার জানা ছিল সবগুলোতেই ডিসকানেকটেড।
দুচোখে কেমন অন্ধকার দেখা শুরু করলাম,হাজারটা উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম।
ঠিক তার ১৫ দিন বাদে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসলো আমার রুমমেট এর নম্বরে,আমি তখনও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাইনি।ও বলতেই ভুলে গেছিলাম টানা ৪ দিন যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টার পর আমি আর টিকতে পারছিলাম না,কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা,ইত্যাদি ইত্যাদি যা হয় আর কি,ভীষণ ভেঙে পড়া,সাইকোথেরাপি শেষমেষ হাসপাতালের বেড।
আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যাওয়া হলো,ইন্টারনেট ভার্চুয়াল জগত থেকে একদম দূরে রাখা হলো ডাক্তারের নির্দেশে,প্রতিদিন ১২-১৩ঘন্টা ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পড়িয়ে রাখা হয় আমাকে আর বাকি মুহূর্তগুলো আমি কাছে পাই আমার কাছের কিছু বন্ধু আর আমার মাকে।সেদিন মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না,একটা মানুষ কিভাবে এতটা কষ্টের মধ্যে ও আমার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে মিথ্যে হাসছে,আমি অবশ্য মায়ের নকল হাসিটা বুঝতে এক মুহূর্ত ও দেরি করিনি।
কিছুক্ষণ বাদে আমার রুমমেট এসে আমার পাশে বসলো,কিছু যে একটা লুকচ্ছে সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। আমি প্রথমে ভাবছিলাম হয়তো ডাক্তার আমাকে নিয়ে কোনো দুঃসংবাদ দিয়েছে তাই ও আমায় বলছে না।অনেক অনুনয় বিনয় শেষে ও বলেই ফেললো আমাকে,গত রাতে একটা একটা কল আসছিল,গত পরশু ওর বিয়ে হয়ে গেছে;
সত্যি,কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি মরে গেছি,আমার অনুভূতিগুলো ঠিক কাজ করেছে না।চেষ্টা করছিলাম ভীষণ নিজেকে শান্ত রাখার পারিনি,কয়েকটা চিৎকার দিলাম,হাতের কাছে থাকা ২টা গ্লাস ও ভাঙলাম,
কোথায় যেন একটা লেখায় পড়েছিলাম যে কষ্টগুলোকে বের করে দিতে হয়,পুশে রাখতে নেই,এখন আমি ঠিক সেটাই করছি।
মাসখানেক পড়ে ডাক্তার আমাকে রিলিজ দিলো,
শুরু হয়েছিল আমার নতুন লড়াই,নতুনভাবে বাঁচার,
আর এই লড়াইটা আমার জন্য ভয়ংকর কষ্টকর ছিল কারন, ওর সাথে এই ৪ বছরে আমার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে,ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল প্রতেকটা মুহূর্ত সারভাইভ করতে।জাস্ট অভিনয় করে যাচ্ছিলাম অন্যের জন্য নয় নিজের কাছে নিজেকে ভালো রাখার জন্য।শুরুর দিকটায় আমি কোথাও বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারতাম না বা সবকিছুতেই ওকে খুঁজতাম,ভীষণ কান্না পেত তখন।আর যাইহোক একটা ২৪বছরের ছেলে অন্তত কথায় কথায় কাঁদতে পারেনা। আমার এবারের লড়াইটা ছিলো এই কান্নার বিপরীতেই,ওইসময়  টি.ফিলিপস এর নির্মিত একটা বেশ সাড়া জাগানো সিনেমা চলছিল,সিনেমাটি বেশ মনে ধরেছিলো আমার কারন ওখানটাতেও একজন লোকের একটা সার্ভাইভাল স্টোরি ছিলো।ঠিক ওখান থেকেই শিখলাম কান্নাটাকে কিভাবে হাসিতে রুপান্তরিত করতে হয়।এরপর বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় অথবা মাঝরাতে বিকট শব্দ করে বহুবার হেসেছি কেউ কেউ পাগল বলেছে কেউ কেউ এর কারণ খুঁজতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে;কিন্তু আজ অব্ধি আমি এই হাসিটা ছাড়িনি,এই হাসিটাই যে আমার বেঁচে থাকার রসদ। তারপরের অনেকগুলো দিন শুধু একটা প্রশ্নের ই উত্তর খুঁজেছিলাম 'একটাবার কি আমাদের এই গল্পটা সুন্দরভাবে শেষ করা যেতোনা,তাহলে সেদিন কেনো কিছু না বলেই ও হঠাৎ ই আমার থেকে দূরে চলে গেলো' অবশ্য একটা সময় পর উত্তর খোঁজা বন্ধ ও করে দিয়েছিলাম।
এরপর বহুদিন পেরোলো,পাঁচ বছর প্রায়; নিজেকে আর কারো কাছে ধরা দেইনি,অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণায় কেটে গেছে আমার জীবনের এই শেষ ৫টি বছর।
পরিবার বেশ জোড়াজুড়ি করলো,বিয়ে করলাম,সংসার পাতলাম।
একটা সময় বন্ধুদের কাছে নিজেকে লুকাতাম,এখন বিনুর কাছে লুকাই,লুকানোটা আমার রক্তে মিশে গেছে,বহুদিন হয়ে গেছে মুখোশের আড়ালে লিজেকে ঢেকে রাখছি,বুড়ো হয়ে যাচ্ছি,মুখোশে মড়চে ধরতে শুরু করেছে,ভয়ে আছি কোনদিন না আবার মুখোশটা খুলে পড়ে যায়।
বিনুর সাথে বেঞ্চিতে বশে আছি,ওর কথা আর কলহাস্যগুলো আমার কান ভেদ করতে পারছেনা।
হ্যাঁ, না,আচ্ছা বলেই ওর কথার উত্তরগুলো শেষ করছি নিত্যান্তই দায়বদ্ধতার খাতিরে।
শেষ বিকেলের সূর্যের তীক্ষ্ণ আভা এসে ছুঁলো আমাদের।কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে এলো।পুরানো বন্ধুর কলে সম্বিত ফিরে পেলাম,
রিসিভ করতেই বুঝলাম খুব জরুরী কথা,
ও বললো আমি কিছু জানি কিনা,না উত্তর দিতেই ও আবার বললো,আজ সকালে রিতা মারা গেছে,একিউট লিউকেমিয়ায় শেষ ৬মাস ভুগেছিল।আমি অবশ্য সেই ভার্সিটি ছাড়ার সাথে সাথেই ওর পাঠও শেষ করেছি,কখনো আর নূন্যতম যোগাযোগের চেষ্টা ও করিনি।পাঠক চিনতে পেরেছেন তো,ইনিই সেই রিতা,ইনিই সেই পরশপাথর যার স্পর্শে আমি আজও ভয়ংকর পিন্ড হয়ে আছি।ফোনের এ প্রান্ত থেকে ওকে খুবই ঠান্ডা গলায় বললাম'পুরানো কাসুন্দি ঘেটে কি লাভ'ওকে তো সেই কবেই চিতায় চড়িয়ে এসেছি '।
কেনো জানি আজকের বিকেলটা আমার কাছে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।
কিছুক্ষনের জন্য মনে হলো জীবনে কোনোদিন আমি এত সুন্দর বিকেল দেখিনি।
একটা কোকিলের সুর ভেসে আসছে দূর থেকে,পলাশগুলো হঠাৎ কেমন ভীষণ গাঢ় রক্তবর্ণ ধারন করেছে।বীনুর হাতে হাত রাখলাম,বহুকাল পরে আবার নিজের খোলস আর মুখোশ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।
চারদিকের পৃথিবীটা কি ভীষণ সুন্দর লাগছে,সবকিছু কেমন আমার কাছে নতুনরুপে ধরা দিচ্ছে।
আনন্দের অতিসাহ্যে ওর কপালে একটা চুমুও এঁকে দিলাম।রাত ঘনিয়ে আসছে,আজান পরে গেছে,দূরে একদল লোক মশাল হাতে মিছিল করছে।
বিনু আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি,
চমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য।
সেই পুরানো শব্দ,পুরানো আমি আর নতুন একটা মানুষ।আমি বললাম বিনু,তোমার কাছে একটা আবদার আছে জানি কিছুটা খারাপ লাগবে শুনতে তাও বলছি,তুমি কখনে আমাকে ভালোবাসি শব্দটা বলোনা,আমার কাছে একমাত্র ভালোবাসি শব্দটাই পৃথিবীর সবথেকে বেশি সস্তা,সবথেকে বেশি জঘন্য।এই শব্দটার সাথে আমি মাননসই নই।এরপর টানা
২ দিন ধরে বিনু আমার সাথে কথা বলছে না,বুঝতে পারলাম কথাটা তাকে ভীষণ পুড়িয়েছে।
তারপর,
তারপর আবার সেই পুরানো খোলস,পুরানো মুখোশে জড়িয়ে নিলাম নিজেকে,সেই পুরানো কৃত্রিম হাসিটাকে আবার টেনে তুললাম।
বিনুকে অনেক কষ্টে বুঝালাম ওইদিনের কথাটা নিছকই বানোয়াট ছিলো,যদিওবা ভেতরে তখনও সেই পুরানো ক্ষতের দাগ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। 
নিজেকে এত এত লুকানোর মাঝে সহসা আজ মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশ্নের জন্ম নিলো,'আসলেই আমি কি মানুষ,নাকি একাবিংশ শতাব্দীর উদ্ভুত কোনো যন্ত্র...?????

#মুখোশের আড়ালে

হাসিবুর রহমান ভাসানী

   

Post a Comment

0 Comments